আজ বুধবার, ২৬ মার্চ ২০২৫, ০৪:০২ পূর্বাহ্ন
পল্লী জনপদ ডেস্ক॥
বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার চিকিৎসার জন্য গঠিত মেডিকেল বোর্ডের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন যে খালেদা জিয়ার ‘মৃত্যুঝুঁকি অত্যন্ত বেশি’ এবং তার লিভার প্রতিস্থাপন করার লক্ষ্যে অতিসত্ত্বর বিদেশে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। সোমবার (৯ অক্টোবর) রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় এভারকেয়ার হাসপাতালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার চিকিৎসা ও শারীরিক সর্বশেষ অবস্থা নিয়ে করা এক সংবাদ সম্মেলনে মেডিকেল বোর্ডের চিকিৎসক অধ্যাপক এফ এম সিদ্দিকী এসব কথা বলেন। তিনি আরো বলেন, খালেদা জিয়ার লিভার প্রতিস্থাপন করার সুযোগ দেয়া হলে দীর্ঘ সময় সুস্থভাবে বাঁচার সম্ভাবনা রয়েছে। খালেদা জিয়ার প্রধান ব্যক্তিগত চিকিৎসক ফখরুদ্দিন মোহাম্মদ সিদ্দিকী সংবাদ সম্মেলনে জানান যে খালেদা জিয়ার মূল অসুস্থতা ‘লিভার সিরোসিস জনিত পোর্টাল হাইপারটেনশন’।
“যতক্ষণ পর্যন্ত সিরোসিস জনিত পোর্টাল হাইপারটেনশনের চিকিৎসা না করা হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তার অবস্থার অবণতি হতে পারে। আর এই অসুস্থতার চিকিৎসা হচ্ছে ট্রান্সজুগুলার ইন্ট্রাহেপাটিক পোর্টোসিস্টেমিক শান্ট বা টিআইপিএস এবং তারপর লিভার প্রতিস্থাপন”, বলেন চিকিৎসক সিদ্দিকী। হৃদরোগ, ডায়বেটিস, কিডনি ও লিভারের জটিলতাসহ নানা শারীরিক সমস্যায় খালেদা জিয়া ভুগছেন বলে জানান সিদ্দিকী। বর্তমান অবস্থায় মেডিকেল বোর্ডের ‘সমস্ত চিকিৎসার সুযোগ শেষ হয়ে আসছে’ বলেও জানান ডাক্তার ফখরুদ্দিন সিদ্দিকি। “বিদেশে উন্নত মাল্টিডিসিপ্লিনারি সেন্টারে তার টিআইপিএস পরবর্তী লিভার প্রতিস্থাপন করা গেলে এখনো হয়তো আমরা তার অবস্থার উন্নতি ঘটাতে পারবো।”
খালেদা জিয়ার মেডিকেল বোর্ডের সদস্য ও গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজিস্ট একিউএম মহসিন জানান বাংলাদেশে একসময় সীমিত সংখ্যক লিভার প্রতিস্থাপন করা হলেও বর্তমানে বাংলাদেশে লিভার প্রতিস্থাপন করার মত যথেষ্ট সুবিধা নেই। এরকম পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়ার মত জটিল শারীরিক পরিস্থিতির রোগীকে লিভার প্রতিস্থাপন করা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ বলে মন্তব্য করেন তিনি। এছাড়া টিআইপিএস চিকিৎসাও বাংলাদেশে করা সম্ভব নয় বলে জানান চিকিৎসক ফখরুদ্দিন সিদ্দিকি। হেপাটোলজিস্ট অধ্যাপক নুরউদ্দিন আহমেদ বলছিলেন লিভার সিরোসিসের সংক্রান্ত অনেকগুলো ‘মারাত্মক জটিলতা’ রয়েছে খালেদা জিয়ার।
সংক্রমণের চিকিৎসায় অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করতে করতে সেগুলো আর কাজ করছে না বলে জানান তিনি। “তার লিভার ঠিক করার জন্য এখন একমাত্র চিকিৎসা শুরুতে টিআইপিএস করা এবং তারপর লিভার প্রতিস্থাপন করা। আমাদের দেশে সেই সুযোগ নেই। এই চিকিৎসা সম্ভব কিনা তা বিদেশে বড়, উন্নত লিভার সেন্টারে যাচাই করা সম্ভব।” বাংলাদেশে এই মুহুর্তে খালেদা জিয়ার চিকিৎসা করার মত ‘আর কোনো ব্যবস্থা নাই’ বলে জানান হেপাটোলজিস্ট মি. আহমেদ। তিনি বলেন সঠিকভাবে চিকিৎসা করা হলে খালেদা জিয়ার আরো অনেক বছর সুস্থভাবে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা আছে।
টানা দুই বছর কারাভোগের পর অসুস্থতার কারণে সরকারের নির্বাহী আদেশে মুক্তি পেয়ে ২০২০ সালের মার্চে বাসায় ফিরে গিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। এরপর থেকে এ পর্যন্ত আটবার তার মুক্তির সময়সীমা বাড়িয়েছে সরকার। অসুস্থতার কারণে এরপরের বছরখানেক সময়ের মধ্যে কয়েক দফায় খালেদা জিয়াকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয়।
বর্তমান মেডিকেল বোর্ড ২০২১ সালের এপ্রিল মাস থেকে খালেদা জিয়ার চিকিৎসার দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছেন। সেসময় বিএসএমএমইউ থেকে বাড়িতে ফেরার পর ২০২১ সালের এপ্রিলে তার লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি মেডিকেল বোর্ড জানতে পারে বলে জানাচ্ছিলেন মেডিকেল বোর্ডের একজন সদস্য ও খালেদা জিয়ার প্রধান ব্যক্তিগত চিকিৎসক ফখরুদ্দিন মোহাম্মদ সিদ্দিকী। “খালেদা জিয়ার ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, কিডনি রোগ, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসসহ অনেকগুলো জটিল রোগ থাকায় তার লিভার সিরোসিস জটিলতর হতে পারে বলে উদ্বেগ সবসময়ই ছিল।”
সেসময় মেডিকেল বোর্ড সংবাদ সম্মেলন করে খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য মাল্টিডিসিপ্লিনারি বিদেশি হাসপাতালে নেয়ার আহ্বান জানায়। এরপর ২০২১ সালের নভেম্বরে অসুস্থ হয়ে পড়লে খালেদা জিয়াকে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর খালেদা জিয়ার একাধিকবার খাদ্যনালিতে সংক্রমণ ও রক্তপাত হয়েছিল। এরপর ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে তার পেটে পানি আসার সমস্যা, অ্যাসাইটিস শুরু হয়। প্রাথমিকভাবে তার এই সমস্যার সমাধান বাসায় রেখে করার চেষ্টা করলেও অগাস্টের শুরু থেকে পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় অগাস্টের ৯ তারিখে তাকে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
এরপর জানা যায় যে তার পেটের পানি জীবাণু দিয়ে সংক্রমিত হয়েছে। অগাস্টের শেষদিকে চিকিৎসা চলাকালীন অবস্থায় ইন্ট্রাভেনাস সেন্ট্রাল লাইনের মাধ্যমে খালেদা জিয়ার রক্তে সংক্রমণ, সেপটিসেমিয়া তৈরি হয়। এর মধ্যে তার পেটে পানি বাড়তে থাকে এবং পেট থেকে পানি ফুসফুসে প্রবেশ করে, যার ধারাবাহিকতায় সেপ্টেম্বর মাসে দু্ইবার খালেদা জিয়াকে সিসিইউতে ভর্তি করার দরকার হয়।
পরবর্তীতে এক পর্যায়ে তার পেটের ভেতরে রক্তক্ষরণও হতে থাকে এবং তাকে রক্তও দেয়া প্রয়োজন হয় বলে জানানা তার মেডিকেল বোর্ডের চিকিৎসকরা। “যদি আমরা দুই বছর আগে তাকে উন্নত চিকিৎসা দিতে পারতাম, তাহলে আজকে তার পেটে রক্তক্ষরণ হত না বা পেটে পানি জমতো না।” বিএনপি নেতারা সবসময়ই বলে আসছিলেন যে ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার অবস্থা ‘সংকটাপন্ন।’
গত মাসের শেষদিকে সামাজিক মাধ্যমে এমন একটি প্রচারণা ছড়িয়ে পড়েছিল যে খালেদা জিয়াতকে ‘বিদেশে নেয়া হচ্ছে’। তবে সেসময় দল ও পরিবারের সূত্রগুলো জানিয়েছিল যে তাকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেয়ার অনুমতি দেয়ার কোনো ইঙ্গিত সরকারের দিক থেকে তাদের দেয়া হয়নি। সেসময় তার পরিবারের পক্ষ থেকে খালেদা জিয়াকে বিদেশে নেয়ার জন্য আবেদন করা হয় সরকারের কাছে। কিন্তু আইন মন্ত্রণালয় সেই আবেদন বাতিল করে দেয়।
তবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানান ফৌজদারি কার্যধারার ৪০১ এর একটি উপধারা অনুযায়ী দুটি শর্তে তাকে বাসায় থেকে চিকিৎসা নেয়ার যে অনুমতি দেয়া হয়েছিলো সে আদেশও তারা বাতিল করবেন না। ফলে সরকারের যে নির্বাহী আদেশে মিসেস জিয়া শর্তসাপেক্ষে বাসায় থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন সেই আদেশ বাতিল না করলে তার আপাতত জেলেও ফেরত যাওয়ার সুযোগ নেই। বিএনপি আইন মন্ত্রণালয়ের এ সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছিল।
৭৮ বছর বয়সি খালেদা জিয়া হার্টের সমস্যা ও লিভারসিরোসিস ছাড়াও নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন। এছাড়া, আর্থ্রাইটিস, ডায়াবেটিস, দাঁত ও চোখের সমস্যাসহ নানা জটিলতা রয়েছে তার। এরই মধ্যে কয়েক দফা হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেন তিনি। গত বছরের জুনে খালেদা জিয়ার এনজিওগ্রাম করা হলে তার হৃদযন্ত্রে তিনটি ব্লক ধরা পড়ে। এর একটিতে রিং পরানো হয়। শারীরিক অবস্থার তারতম্যের কারণে সম্প্রতি কয়েক দফায় বেগম খালেদা জিয়াকে হাসপাতালের কেবিন ও সিসিইউতে স্থানান্তর করা হয়।
দুটি মামলায় সাজা হওয়ায় কারাবন্দি ছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। বর্তমানে নির্বাহী আদেশে দণ্ড স্থগিত থাকায় তিনি কারামুক্ত রয়েছেন। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেন ঢাকার ৫ নম্বর বিশেষ আদালত। রায়ের পর তাকে পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডের পুরানো কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি রাখা হয়। এরপর ৩০ অক্টোবর এই মামলায় আপিলে তার সাজা আরও পাঁচ বছর বাড়িয়ে ১০ বছর করেন হাইকোর্ট।
একই বছরের ২৯ অক্টোবর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়াকে ৭ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং ১০ লাখ টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও ৬ মাসের কারাদণ্ড দেন একই আদালত। ২০২০ সালের মার্চে করোনা মহামারি শুরু হলে পরিবারের আবেদনের প্রেক্ষিতে সরকার নির্বাহী আদেশে দণ্ড স্থগিত করে খালেদা জিয়াকে শর্তসাপেক্ষে ছয় মাসের জন্য মুক্তি দেয়। এরপর থেকে মুক্তির মেয়াদ বাড়তে থাকায় তাকে আর কারাগারে যেতে হয়নি।