আজ বৃহস্পতিবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯:৪২ অপরাহ্ন
পল্লী জনপদ ডেস্ক॥
বাংলাদেশের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের পর নতুন সরকারকে দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণে বেশ কিছু ক্ষেত্রে শক্ত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা না নিতে পারলে রিজার্ভ, রেমিট্যান্স, রপ্তানি আয় ছাড়াও রাজস্ব ও ব্যাংক খাত নিয়ে যে ভয়াবহ উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তা থেকে উত্তরণ কঠিন হবার আশংকা আছে অনেকের মধ্যে।
অর্থনীতিবিদ ড: দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এবং আহসান এইচ মনসুর দুজনেই বলছেন, অর্থনীতিকে একটি স্থিতিশীল অবস্থায় নিয়ে আসাটাই হবে নতুন সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু ‘নির্বাচনের নৈতিক মানদণ্ডে দুর্বল’ একটি সরকারের পক্ষে তা সহজ হবে না।
অর্থনীতিবিদ ড: দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, “এখন যেহেতু আর বিশেষ কোন নীতি সংস্কার হবে না, তাই নির্বাচনের পর দ্রব্যমূল্য, মুদ্রা বিনিময় হার ও ব্যাংক ঋণের সুদের হারে মনোযোগ দিতে হবে। আর খেয়াল রাখতে হবে ব্যাংক বা কোন খাতে যেন কাঠামোগত সংকট না হয়। আবার বৈদেশিক দায় দেনা পরিশোধের ক্ষেত্রেও যেন কোন সমস্যা তৈরি না হয়।” আর আহসান এইচ মনসুর বলছেন, আর্থিক খাতে সুশাসন আনা এবং শুরুতেই বর্তমান বাজেটের আকার অন্তত এক লাখ কোটি টাকা কমিয়ে টাকাকে আকর্ষণীয় করার চ্যালেঞ্জ নিতে হবে নতুন সরকারকে।
প্রসঙ্গত, চলতি অর্থবছরের জন্য সাত লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেট পাস হয়েছিলো চলতি বছরের জুনে।
কিন্তু নানা কারণে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ার জের ধরে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমতে কমতে ১৬ বিলিয়ন ডলারে এসে ঠেকেছে এবং ডলারের বাজারের অস্থিতিশীলতা নানা পদক্ষেপ নিয়েও কাটানো যাচ্ছে না।এসবের জের ধরে বছর জুড়ে মূল্যস্ফীতি নয় শতাংশেরও বেশী হওয়ায় দ্রব্যমূল্য বেড়ে জনজীবনে দুর্ভোগ চরমে উঠেছে।
অন্যদিকে রাজনীতি ও নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তার কারণে কমেছে বিদেশি বিনিয়োগ, প্রবৃদ্ধি হচ্ছে না রপ্তানি বাণিজ্যে আবার রিজার্ভ বাঁচাতে আমদানি ব্যাপকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হচ্ছে।
আহসান এইচ মনসুর বলছেন, এই কঠিন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য নতুন সরকারকে দ্রুত কিছু স্বল্প ও মধ্যমেয়াদী কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হবে, কিন্তু তার জন্য দরকার হবে অর্থমন্ত্রীর নেতৃত্বে রাজনৈতিক প্রজ্ঞাময় একটি চৌকস অর্থনৈতিক টিম।
তার মতে এটি না থাকার কারণেই অর্থনীতির দুরবস্থায় পতন ঠেকাতে পারেনি শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার।বিএনপিসহ বেশিরভাগ বিরোধী দল নির্বাচনে অংশ না নেয়ায় বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগই নতুন সরকারে আবার নেতৃত্ব দিতে যাচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ফলে কার্যত বতর্মান ক্ষমতাসীন নীতিনির্ধারকরাই নতুন সরকারে থাকছে।
বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করে অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলোর যে তালিকা তার প্রথমেই থাকা উচিত মুদ্রা বিনিময় হার। বিনিময় হার বলতে বোঝায় এক দেশের সাথে আরেক দেশের মুদ্রার যে বিনিময় হার। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সেটি ডলার ও টাকার।
কিন্তু বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত দুবছর এর সঠিক ব্যবস্থাপনা করতে পেরেছে কি-না তা নিয়ে বড় সমালোচনা আছে অর্থনৈতিক অঙ্গনে।
মুদ্রা বিনিময় হার নির্ধারিত হওয়ার কথা বাজারের চাহিদা ও যোগানের ভিত্তিতে। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিরুদ্ধে বড় সমালোচনা হলো তারা কখনোই সেটি হতে দেয়নি। ডলার কেনাবেচাসহ নানা কায়দায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেটি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করার কারণে কিছুদিন ডলারের দাম আটকে রাখা গেলেও শেষ পর্যন্ত তা লাগামহীন হয়ে গেছে।
এখন পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে টাকার মান ধরে রাখা যাচ্ছে না রিজার্ভ কমে যাওয়ায় আবার ডলার বিক্রি করলে টাকার তারল্য কমে চাপ পড়ছে সুদের হারের ওপর। এই দুটি বিষয়- মুদ্রা বিনিময় হার ও সুদের হারের বিষয়ে সময়মতো পদক্ষেপ নেয়া যায়নি বলেই অর্থনীতির বেহাল দশাও ঠেকানো যায়নি বলে বিশ্লেষকরা বলছেন।
সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদ হার বাড়ানো এবং টাকা ছাপিয়ে ধার না দেয়ার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা আরও আগে নিলে পরিস্থিতি এতো বিপর্যয়কর হতো না বলে অনেকের ধারণা।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলছেন রাজস্ব আয় বাড়াতে না পারলে সরকার বিদেশি সহায়তা নিয়েও কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে পারেনা। এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় হবে – “প্রবৃদ্ধির ধারা কমিয়ে মূল্যস্ফীতি কমানো, টাকাকে আকর্ষণীয় করা ও সুদের হার বাড়ানো”।
নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড: আহসান এইচ মনসুর বলছেন এখন অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আনতে হলে শুরুতেই মুদ্রা বিনিময় হারে স্থিতিশীলতা আনতে হবে।
“আর সেটা করতে হলে মূল্যস্ফীতি কমাতে হবে। সেজন্য দরকার হবে ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাড়ানো। এর মধ্যেই সরকার কিছু বাড়িয়েছে, কিন্তু এটি আরও বাড়াতে হবে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি। এছাড়া রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে খুব বেশি উন্নতির সুযোগ নেই বিবেচনায় অভ্যন্তরীণ সূত্র থেকে আয় বাড়ানো অর্থাৎ রাজস্ব আয় কীভাবে বাড়ানো যাবে-সেটিও একটি বড় চ্যালেঞ্জ হবে সরকারের জন্য।
সরকার যে আইএমএফ এর কাছ থেকে ঋণ নিচ্ছে তারও একটি বড় শর্ত হলো এই রাজস্ব বাড়ানো। এজন্য এ খাতের সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন জরুরি বলে মনে করেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
নতুন সরকারের জন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হবে অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার কারণে দেশের ব্যাংক খাত যেন কাঠামোগত বিপর্যয়ে না পড়ে সেটি নিশ্চিত করা। দেশের অধিকাংশ ব্যাংকই এখন রীতিমত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে চলছে। কিছু ব্যাংক পুরোপুরি সক্ষমতা হারিয়েছে অনেক আগেই।
আহসান এইচ মনসুর বলছেন ব্যাংকিং খাতে ব্যাপক সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ নিতে হবে নতুন সরকারকেই। “প্রয়োজনে অনেক ব্যাংককে অন্যদের সাথে একীভূত কিংবা গুটিয়ে ফেলতে হবে। অনিয়মের সাথে জড়িতদের শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে,” বলছিলেন তিনি।
পাশাপাশি সরকার আইএমএফসহ অন্য দাতাদের কাছ থেকে যেসব সংস্কারের শর্তে ঋণ পাচ্ছে নির্বাচনের পরে সেগুলো বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে না পারলে অর্থনীতিও ঘুরে দাঁড়ানো নিয়ে শঙ্কা তৈরি হতে পারে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন দাতাদের দেয়া প্রতিশ্রুতিগুলো পরিপালনের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ, সমন্বয় ও প্রস্তুতি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে সামনের দিনগুলোতে।
সরকার আইএমএফকে যে হিসেব দিয়েছে তাতের ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ এখন ১৬ বিলিয়ন ডলার আর রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্সে প্রবৃদ্ধি নেই। বাজারে ডলার সংকটের কারণে অস্থির অবস্থা তৈরি হয়েছে অর্থনীতিতে। আমদানি নিয়ন্ত্রণের পরেও ডলার পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা যায়নি। আবার ব্যাংকগুলোর বেশীরভাগই টিকে আছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সহায়তা নিয়ে। অর্থনীতিকে টালমাটাল করে দেয়া এসব খাতের চিত্র আসলে কেমন:
চলতি বছরের ৩০ জুন রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ১২০ কোটি ডলার। বেশ কয়েক মাস ধারাবাহিকভাবে রিজার্ভ কমার পর চলতি মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে যে এ মাসে রিজার্ভ আর কমবে না বলেই আশা করছেন তারা।মূলত আইএমএফের ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি চলতি মাসেই অনুমোদিত হওয়ার কথা রয়েছে এবং এর ওপর ভিত্তি করেই রিজার্ভের স্থিতির আশা করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র জানিয়েছেন এ মাসে এক বিলিয়ন ডলারের বেশি ঋণের অর্থ রিজার্ভে যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকায় এ মাসে আর রিজার্ভ কমছে না বলেই মনে করেন তারা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ নভেম্বরে মোট রিজার্ভের পরিমাণ ছিলো ২৫.১৬ বিলিয়ন ডলার। তবে আইএমএফ এর প্রস্তাবিত বিপিএম৬ পদ্ধতি অনুসরণ করে করা হিসাব অনুযায়ী এ রিজার্ভ ছিলো ১৯.৫২ বিলিয়ন ডলার। যেটি সাতই ডিসেম্বর নাগাদ ছিলো ১৬ বিলিয়ন ডলারের সামান্য বেশি।
করোনা মহামারির মধ্যেই ২০২১ সালের অগাস্টে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ উন্নীত হয়েছিল দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ৪৮ দশমিক ০৪ বিলিয়ন ডলারে। সে বছর ২৯শে জুলাই সেই অর্থবছরের মুদ্রানীতি ঘোষণা করে বাংলাদেশ ব্যাংকের তখনকার গভর্নর ফজলে কবির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সেই অর্থবছরেই ৫২ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবার আশা প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু পরের বছর জুলাই থেকেই রিজার্ভের যে পতন শুরু হয়, সেটি আর সামাল দেয়া যায়নি।
গত তেসরা ডিসেম্বর প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, নভেম্বর মাসে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে দেশে এসেছে ১৯৩ কোটি ডলার রেমিট্যান্স। দেশীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ ২১ হাজার ২৩০ কোটি টাকা (প্রতি ডলার ১১০ টাকা করে ধরে)। আগের মাস অক্টোবর মাসে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৯৭ কোটি ৭৫ লাখ ডলার।
রেমিট্যান্স বাড়ানোর জন্য হুন্ডি বা অবৈধ পথে টাকা আসা বন্ধের কথাই সবসময় বিশ্লেষকরা বলে আসছেন। আর হুন্ডি বন্ধের জন্য জরুরি হলো টাকা পাচার বন্ধ করা। বিশ্লেষকদের ধারণা এখনো প্রচুর টাকা পাচার হচ্ছে বলেই হুন্ডিতে টাকা আসা বন্ধ করা যাচ্ছে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে দেশে প্রবাসী আয় এসেছিল ১৩৩ কোটি ডলার। এর আগে জুলাই ও আগস্ট মাসে এই আয় এসেছিল যথাক্রমে ১৯৭ কোটি ও ১৫৯ কোটি ডলার।
গত জুনে অবশ্য রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স এসেছিলো বাংলাদেশে, যার পরিমাণ ছিলো ২১৯ কোটি ৯০ লাখ ডলার। একক মাস হিসেবে সেটি ছিলো তিন বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। তবে এরপরই রেমিট্যান্স প্রবাহ কমতে শুরু করে।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য অবশ্য বলছেন বাংলাদেশের জন্য রেমিট্যান্স ম্যাজিকের দিন শেষ হয়েছে আগেই এবং এটি এখন ওঠানামার মধ্যেই থাকবে। “নির্বাচনের পরে ২০২৪ সালের ওই সময়টাতে আন্তর্জাতিক অর্থনীতির ক্ষেত্রেও বড় উন্নতি আশা করা যাচ্ছে না, অর্থাৎ রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্সের প্রবাহের প্রবণতার খুব একটা পরিবর্তন আসবে না,” বলছিলেন তিনি।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর হিসেবে চলতি বছরের নভেম্বরে দেশে রপ্তানি আয় এসেছে ৪ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার, যা গত বছরের নভেম্বরে ছিল ৫ দশমিক ০৯ বিলিয়ন ডলার। গত বছরের তুলনায় এই নভেম্বরে রপ্তানি আয় কমার কারণ হিসেবে সংস্থাটি তৈরি পোশাক খাতের রপ্তানি কমে যাওয়াকে প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছে।
ব্যুরোর দেয়া তথ্য মতে, চলতি বছরের অক্টোবরেও রপ্তানি আগের বছরের এই সময়ের তুলনায় কমেছে। এ বছর অক্টোবরে রপ্তানি আয় এসেছে ৩ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলার, যা এক বছর আগে ছিল ৪ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলার।
মূলত জুলাই মাসের পর থেকেই রপ্তানি আয় কমছে। যদিও বাজেটে আগের বছরের চেয়ে সাড়ে এগার শতাংশ বেশি মোট ৭২ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রার কথা বলা হয়েছিলো। গত অর্থবছরেও ৫৮ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে অর্জন করা হয়েছিলো ৫৫ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি।
ব্যাংকগুলোতে নগদ টাকার যে সরবরাহ তাকেই তারল্য বলা হয়। কোন কারণে ব্যাংকে নগদ টাকার সরবরাহের তুলনায় চাহিদা বেড়ে গেলে তাকে তারল্য সংকট বলে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বুধবার পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও আন্তঃব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোর ধারের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬২ হাজার ৩০৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেই ধার করা হয়েছে ৫৫ হাজার ৮৭২ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। এটি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ধার নেয়ার সর্বোচ্চ রেকর্ড।
বুধবার একদিনেই কিছু ব্যাংক ও আর্থিক সংস্থা কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ২৩ হাজার ২৩৯ কোটি টাকা ধার নিয়েছে, যা সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে একটি রেকর্ড। এর আগে নভেম্বর মাসেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ধার নিয়ে চলেছে দেশের অর্ধেকের বেশি ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ২০২১ সালের জুন মাসে তারল্য উদ্বৃত্ত ছিল দুই লাখ ৩১ হাজার কোটি টাকা। ২০২২ এর জুনে এটি কমে দাঁড়ায় এক লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকায়।
২০২৩ সালের জুনে দেশে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৭ শতাংশে। এর আগের বছর তা ছিল ৭ দশমিক ৬ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য বলছে, আগস্টে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ৯ দশমিক ৯২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ২০২১ সালের মাঝামাঝি থেকেই দেশের মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী। বাজারে প্রতিটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। এর আগে খাদ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি ছিল ২০১১ সালের অক্টোবরে- ১২.৮২ শতাংশ। খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেশি বেড়েছে গ্রামীণ এলাকায়। সেখানে এর পরিমাণ ১২.৭১ শতাংশ। গত জুলাইতে এটি ছিল ৯.৮২ শতাংশ।
সব মিলিয়ে ২০২৩ সালে গড় মূল্যস্ফীতি ৯.৪০ শতাংশ। এমন এক সময়ে এই মূল্যস্ফীতি বাড়ছে যখন আশেপাশের দেশসহ সারা বিশ্বে এটি কমে আসছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা ছাপিয়ে ধার দেওয়াটাই মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিয়েছে। তাদের দাবি পৃথিবীর প্রায় সব দেশ সুদহার বাড়িয়ে যেখানে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করেছে সেখানে বাংলাদেশ হেঁটেছে উল্টো পথে। ব্যবসায়ীদের সুবিধা দিতে কৌশলে সুদহার কমিয়ে রাখা হয়েছিলো। তাছাড়া বাজার অব্যবস্থাপনার কারণেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে। আহসান এইচ মনসুর বলছেন টাকাকে আকর্ষণীয় করতে ছাপিয়ে ধার দেয়া পুরোপুরি বন্ধ করার কোন বিকল্পই নেই।
বিবিসি বাংলাকে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলছেন, নতুন সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে অর্থনীতির ক্ষেত্রে আস্থা তৈরি করে একটি স্থিতাবস্থায় নিয়ে আসা। বিশেষ প্রয়োজন উন্নয়ন সহযোগিতা, বাণিজ্য ক্ষেত্র ও অভ্যন্তরীণ বাজারে আস্থার পরিবেশ তৈরি করা।
“কিন্তু এটি খুব কঠিন হবে কারণ বাজার নিয়ন্ত্রণ বা শৃঙ্খলা আনতে যেসব নীতি কার্যকর করতে হয় সেটা বাস্তবায়ন করার মত নৈতিক তথা রাজনৈতিক অবস্থান সরকারের নেই। মনে রাখতে হবে যাদের কারণে অর্থনীতির এই হাল হয়েছে সে সব ব্যক্তি ও গোষ্ঠী আসন্ন নির্বাচনের পরেও একই ধরনের প্রভাবশালীই থেকে যাবে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
তার মতে, অর্থনীতির ক্ষেত্রে এখনকার যে সমস্যা, তা তৈরি হয়েছে দুটি কারণে। প্রথমত, আগের দুটি জাতীয় নির্বাচনের সাংবিধানিক বৈধতা থাকলেও, রাজনৈতিক ও নৈতিক বৈধতার অভাব ছিল। দ্বিতীয়ত, যারা আর্থ-সামাজিক নীতি ও কর্মসূচি বাস্তবায়নে দুর্নীতি ও বিশৃঙ্খলা তৈরি করেছে তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা যায়নি। ব্যাংকের অনাদায়ী ঋণ, প্রকল্পগুলোর ব্যয় কয়েক গুণ বাড়ানো কিংবা বিদ্যুৎ খাতের ক্যাপাসিটি চার্জ এর অন্যতম উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি। আগের দুটি নির্বাচনের ধারাবাহিকতায় এবারের নির্বাচনও এই সংকট দূর করতে পারবে না বিরোধী দলের অংশগ্রহণ না থাকায়।
ড. ভট্টাচার্য বলছেন এ নির্বাচনের পরও সরকারের নৈতিক রাজনৈতিক বৈধতা ও গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার সক্ষমতা অর্জন করবে না। তাই এই বৈধতার ঘাটতি গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতার অভাব সৃষ্টি করেছে এবং আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের পরেও এই সব ব্যক্তি ও গোষ্ঠী একই রকম প্রভাবশালী থেকে যাবে।
তার মতে, পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকার বিদেশি উন্নয়ন সহযোগীদের সহায়তা নিচ্ছে। এজন্য সরকার এখন আইএমএফসহ অন্যান্যদের যেসব প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে সেগুলো পরিপালন করতে দরকারি উদ্যোগ, সমন্বয় ও প্রস্তুতি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।
“সে জন্য দরকার হবে প্রাতিষ্ঠানিক উন্নতিসহ অভ্যন্তরীণ সংস্কারের লক্ষ্যে আস্থার পরিবেশ তৈরি করা। রাজস্ব আয় বাড়াতে না পারলে সরকার বিদেশি সহায়তা নিয়েও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে পারেনা। এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় বিষয় হবে – প্রবৃদ্ধির ধারা কমিয়ে মূল্যস্ফীতি কমানো, টাকাকে আকর্ষণীয় করা ও সুদের হার বাড়ানো”। নির্বাচনের পর অর্থনীতি ঠিক হয়ে যাবে বলে অনেকে যে দাবি করছেন, তা একটা ভ্রান্ত ধারণা বলে তিনি মনে করেন।
অন্যদিকে পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড: আহসান এইচ মনসুর বলছেন অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আনতে হলে মুদ্রা বিনিময় হারে স্থিতিশীলতা আনতে হবে। আর সেটা করতে হলে মূল্যস্ফীতি কমাতে হবে। সেজন্য দরকার হবে ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাড়ানো। এর মধ্যেই সরকার কিছু বাড়িয়েছে, কিন্তু এটি আরও বাড়াতে হবে।
“নতুন সরকারকে শুরুতেই চলতি অর্থবছরের বাজেটের আকার কমাতে হবে এবং টাকা ছাপানো বন্ধ করতে হবে। এসব ক্ষেত্রে ভারসাম্য এনে টাকাকে আকর্ষণীয় করতে পারলেই টাকা পাচার কিছুটা কমবে বলে মনে করেন তিনি,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
সংকট থেকে উত্তরণে দ্রুততার সাথে ৩-৫ বছরের মধ্যমেয়াদী পরিকল্পনার আওতায় ব্যাংকিং ও রাজস্ব খাতকে আমূল সংস্কারের আওতায় আনা প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন। পাশাপাশি অর্থমন্ত্রীর নেতৃত্বে রাজনৈতিকভাবে পরিপক্ব কিন্তু অর্থনীতিতে দক্ষ এমন একটি দল গঠন করে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য তিনি পরামর্শ দিয়েছেন।
অর্থনৈতিক সংকটের কারণে গত কিছুদিন ধরে অনেক পেমেন্ট বা দেনা শোধ বন্ধ করে রাখা হয়েছিলো। নির্বাচনের পরেই এসব বকেয়া শোধ করার জন্য আলোচনার মাধ্যমে পেমেন্ট রিস্ট্রাকচার বা পুনর্বিন্যাসের ওপর জোর দিয়েছেন তিনি।
“তবে মনে রাখতে হবে সুশাসন আনতে না পারলে কিছুই হবে না। ব্যাংকিং খাতে ব্যাপক সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ নিতে হবে। প্রয়োজনে অনেক ব্যাংককে অন্যদের সাথে একীভূত কিংবা গুটিয়ে ফেলতে হবে। অনিয়মের সাথে জড়িতদের শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে,” বলেছেন আহসান এইচ মনসুর। সূত্র : বিবিসি বাংলা