আজ শনিবার, ২৭ Jul ২০২৪, ০১:৩৮ অপরাহ্ন
পবিত্র আল কুরআনের দৃষ্টিতে তাওবা ও ইস্তিগফারের তাৎপর্য, গুরুত্ব ও ফজিলত
বিশেষ প্রতিবেদক ॥
তওবা একটি আরবি শব্দ যার অর্থ অনুশোচনা করা, মহান আল্লাহ-তা’য়ালার কাছে ফিরে আসা বা প্রত্যাবর্তন করা। পবিত্র কুরআন এবং হাদীসে শব্দটি আল্লাহর নিষেধকৃত বিষয়সমূহ ত্যাগ করা ও তার আদেশকৃত বিষয়সমূহর দিকে ফিরে আসা বোঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে। ইসলামী ধর্মতত্ত্বে শব্দটি নিজের কৃত পাপের জন্য অনুতপ্ত হওয়া, তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা এবং তা পরিত্যাগের দৃঢ় সংকল্পকে বোঝায়।যেহেতু কুরআনে এবং হাদীসে কৃত পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করার বিষয়টি বারংবার উল্লেখ ও গুরুত্বারোপ করা হয়েছে, সে কারণে ইসলামী ধর্তমত্ত্বে তওবার গুরুত্ব অনেক। তওবা ব্যতিরেকে কবিরা গুনাহ মাফ হয় না। যে তওবার পর পাপকর্মের পুনরাবৃত্তি হয় না, তাকে বলে তওবাতুন নাসুহা বা খাঁটি তওবা।
ইস্তিগফারের উপকারিতা :
পবিত্র কুরআনের বহু আয়াতে মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় বান্দাদের অধিক ইস্তিগফারের তাগিদ দিয়েছেন। কারণ আমরা সবাই গুনাহগার। ইচ্ছায়, অনিচ্ছায়, প্রকাশ্যে, গোপনে আমরা প্রতিনিয়তই গুনাহ করে থাকি। কিন্তু আমাদের মধ্যে তারাই উত্তম যারা গুনাহ হয়ে গেলে মহান আল্লাহর দরবারে ক্ষমা চেয়ে নিই। মহান আল্লাহর কাছে প্রতিনিয়ত ইস্তিগফার ছাড়া আমাদের মুক্তির কোনো পথ নেই। আমরা যতই গুনাহগার হই, তিনি তার চেয়ে কোটি গুণ ক্ষমাশীল। তাই পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাও। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৯৯)। অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তোমরা তোমাদের রবের কাছে ক্ষমা চাও।’ (সুরা হুদ, আয়াত : ৩)
হযরত সালেহ (আ.) কতৃর্ক তাঁর উম্মতকে তাওবা ও ইস্তিগফার শিক্ষাদান :
আমি ছামুদ জাতির কাছে সালেহকে প্রেরণ করেছি। তিনি বললেন, হে আমার সম্প্রদায় তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর। তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোনো মাবুদ নেই। তিনিই তোমাদেরকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন। এবং তোমাদেরকে তাতে বসবাস করিয়েছেন। তাই তোমরা তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর। অতঃপর তাঁর দিকেই প্রত্যাবর্তন কর। নিশ্চয়ই আমার রব অতি নিকটে এবং দুয়া কবুলকারী। (সূরা হুদ : ৬১)।
এভাবে সকল নবী উম্মতকে আল্লাহর দরবারে নিজেদের ভুলত্রুটি ও গুনাহের জন্য তাওবা ও ইস্তিগফার করার আদেশ করেছেন এবং নিজেদের জীবনকে শিরকের গুনাহ থেকে শুরু করে সকল গুনাহ থেকে পবিত্র করার জন্য তাওবা ও ইস্তিগফার শিক্ষা দিয়েছেন। তাই দ্বীন ও শরীয়তে তাওবা ও ইস্তিগফারের গুরুত্ব অপরিসীম।
তাওবা ও ইস্তিগফার মুমিনকে আল্লাহ তায়ালার ক্ষমা ও দয়া লাভে সাহায্য করে।
আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন : আর তোমরা আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ বড় ক্ষমাশীল ও অতি দয়ালু। (সূরা বাকারা : ১৯৯)। তিনি আরও বলেন : তোমরা তোমাদের রবের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর। অতঃপর তাঁর কাছে ফিরে আস। নিশ্চয়ই আমার রব অতি দয়ালু ও অধিক মমতাময়। (সূরা হুদ : ৯০)।
তাওবা ও ইস্তিগফারকারীদের প্রতি আল্লাহ শাস্তি প্রেরণ করেন না। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন : আপনি তাদের মাঝে থাকা অবস্থায় কিছুতেই আল্লাহ তাদেরকে শাস্তি দেবেন না। আর তারা ক্ষমা প্রার্থনা করা অবস্থায়ও তাদেরকে শাস্তি দেবেন না। (সূরা আনফাল : ৩৩)।
এমনকি তাওবা-ইস্তিগফারের ফলে আল্লাহর পক্ষ থেকে কোনো জাতির ওপর শাস্তি আসার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরও সে শাস্তিকে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। এক্ষেত্রে হযরত ইউনুস (আ.)-এর কওমের ঘটনা উল্লেখযোগ্য, যা আল্লাহ তায়ালা কুরআন মাজীদে সংক্ষেপে উল্লেখ করেছেন। ইরশাদ হয়েছে : কেন কোনো জনপদবাসীরা ঈমান আনয়নকারী হলো না? তাহলে তাদের ঈমান তাদের উপকারে আসত। তবে ইউনুসের সম্প্রদায় ব্যতিক্রম। তারা যখন ঈমান আনল তখন আমি পার্থিব জীবনে তাদের ওপর থেকে লাঞ্ছনার আজাব তুলে নিলাম এবং তাদেরকে একটা সময় পর্যন্ত জীবন উপভোগ করতে দিলাম। (সূরা ইউনুস : ৯৮)।
হযরত ইউনুস (আ.) তাঁর কওমকে তাওহিদের দাওয়াত দিলেন এবং তাদেরকে বহুভাবে বোঝানোর চেষ্টা করলেন; কিন্তু তারা তাঁর দাওয়াতে সাড়া দিলো না। বরং তাদের অবাধ্যতা ও সীমালঙ্ঘনে ডুবে থাকল। তখন তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে শাস্তি আসার প্রতিশ্রুতি শুনিয়ে দিলেন। হযরত ইউনুস (আ.) যেহেতু বুঝতে পেরেছিলেন যে, তাদের ওপর তো এখন শাস্তি আসা অবধারিত, তাই তিনি নিজ এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য রওয়ানা হলেন। তারা হযরত ইউনুস (আ.) কে যখন খুঁজে পেল না তখন তারা বুঝতে পারল যে, এখন তো আমাদের ওপর শাস্তি এসেই যাবে। তাই তারা তাওবা-ইস্তিগফার করতে লাগল। তাদের এ অবস্থা দেখে আল্লাহ তায়ালা আর শাস্তি প্রেরণ করলেন না। এভাবে তারা তাওবা ও ইস্তিগফারের ফলে আল্লাহর শাস্তি থেকে বেঁচে গেল।
তাওবা ও ইস্তিগফার মুমিনের পার্থিব নিয়ামত, শক্তি সামর্থ্য ও যাবতীয় সমৃদ্ধি লাভে সাহায্য করে। কুরআনে ইরশাদ হয়েছে : আমি বললাম, তোমরা তোমাদের রবের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর। নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমাশীল। তাহলে তিনি তোমাদের প্রতি মুষলধারে বৃষ্টি প্রেরণ করবেন। আর তিনি তোমাদেরকে সম্পদ ও সন্তানাদি বৃদ্ধি করে দেবেন। তিনি তোমাদের জন্য বিভিন্ন উদ্যান ও নদ-নদী সৃষ্টি করে দেবেন। (সূরা নূহ : ১০-১২)।
এভাবে কুরআন মাজীদ তাওবা ও ইস্তিগফারের অনেক ফায়দা ও উপকারের কথা তুলে ধরেছে। তাই আল্লাহ তায়ালার ক্ষমা, দয়া এবং দুনিয়া ও আখিরাতে সব দিক থেকে তাঁর সাহায্য লাভ করার জন্য তাওবা ও ইস্তিগফারের বিকল্প নেই।
তাওবা ও ইস্তিগফারের উপকারিতায় রাসূলে কারীম (সা.)-এর বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন : যে ব্যক্তি বেশি বেশি ইস্তিগফার করবে আল্লাহ তায়ালা তার সকল সংকট থেকে উত্তরণের ব্যবস্থা করে দেন, তার সকল পেরেশানী দূর করে দেন এবং তাকে এমন জায়গা থেকে রিজিক দান করেন, যা সে কল্পনাও করতে পারে না। (সুনানে আবু দাউ : ১৫১৮)।
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসুল (স.) বলেছেন, মহামহিম আল্লাহ-তা’আলা প্রতি রাতের শেষ তৃতীয়াংশ অবশিষ্ট থাকাকালে পৃথিবীর নিকটবর্তী আসমানে অবতরণ করে ঘোষণা করতে থাকেন, কে আছে এমন, যে আমাকে ডাকবে? আমি তার ডাকে সাড়া দিব। কে আছে এমন যে, আমার নিকট চাইবে। আমি তাকে তা দিব। কে আছে এমন যে আমার নিকট ক্ষমা চাইবে? আমি তাকে ক্ষমা করব। (বুখারি, হাদিস : ১১৪৫)।
অতএব, যারা রাতের শেষাংশে মহান আল্লাহর ডাকে সাড়া দেবে এবং ইস্তিগফার করবে, মহান আল্লাহ তাদের ক্ষমা করে দেবেন এবং জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।
মোটকথা, তাওবা ও ইস্তিগফারের মাধ্যমে একজন মুমিনের দুনিয়া ও আখেরাতের জীবন সর্বাঙ্গীন সুন্দর ও সফল হয়। এর মাধ্যমে একজন মুমিন লাভ করে উভয় জাহানের সমৃদ্ধি। সর্বোপরি তাওবা ও ইস্তিগফারের মাধ্যমে মুমিন আল্লাহ তায়ালার নিকটতম বান্দায় পরিণত হয়।
আল্লাহ-তা’য়ালা আমাদের সকলের সগিরা-কবিরা গুনাহসহ সব ধরনের অন্যায়-অপরাধ ক্ষমা করেন। এবং আমাদেরকে সব ধরনের গুনাহ থেকে তাওবা করার তাওফিক দান করেন, আমিন ছুম্মা আমিন।