আজ শনিবার, ২৭ Jul ২০২৪, ০২:৩৯ অপরাহ্ন

Logo
শিরোনামঃ
পবিত্র ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী (স.)’র গুরুত্ব, তাৎপর্য ও ফযিলত

পবিত্র ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী (স.)’র গুরুত্ব, তাৎপর্য ও ফযিলত

পবিত্র ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী (স.)’র গুরুত্ব, তাৎপর্য ও ফযিলত

বিশেষ প্রতিবেদক ॥

মহানবী হজরত মুহাম্মদ (স.)-এর জন্ম ও ওফাত দিবসটি হচ্ছে ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী। দিনটি সমগ্র বিশ্বে মুসলমানদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ। ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে ২৯ আগস্ট, রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ সোমবার, সূর্যোদ্বয়ের ঠিক পূর্বমুহূর্তে, সুবহে সাদিকের সময় মহাকালের এক মহাক্রান্তিলগ্নে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। আবার তেষট্টি বছরের এক মহান আদর্শিক জীবন অতিবাহিত করে ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে ৮ জুন, ১১ হিজরি রবিউল আউওয়াল মাসের ১২ তারিখ একই দিনে তিনি পরলোক গমন করেন। দিনটি মুসলিম সমাজে ‘ঈদে মিলাদুন্নবী (স.) নামে সমধিক পরিচিত।

ঈদ, মিলাদ আর নবী তিনটি শব্দ যোগে দিবসটির নামকরণ হয়েছে। ‘ঈদ’ শব্দের আভিধানিক অর্থ খুশি, আনন্দ, উল্লাস ও ফূর্তি। মিলাদ অর্থ- জন্মদিন আর নবী অর্থ নবী বা ঐশী বার্তাবাহক। এ হচ্ছে বিশ্বমানবতার মুক্তিদূত মহানবী (স.)-এর পৃথিবীর বুকে শুভাগমন উপলক্ষে মুসলিম উম্মাহর তথা সৃষ্টিকুলের জন্য সর্বোচ্চ ও সর্বশ্রেষ্ঠ আনন্দ উৎসব। কারণ রাসুলুল্লাহ (স.) গোটা মানবজাতির জন্য এমনকি সমগ্র বিশ্বের জন্য রহমত ও আশীর্বাদ হিসেবে ধরাধামে আবির্ভূত হন। এ মর্মে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ রব্বুল আলামিন ঘোষণা করেন, ‘আর আমি আপনাকে সমগ্র বিশ্বের জন্য রহমত স্বরূপ প্রেরণ করেছি।’ (সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত- ১০৭)
আল্লাহতায়ালা অন্যত্র ইরশাদ করেছেন, ‘হে রাসূল! আমি আপনাকে বিশ্বের সমগ্র মানুষের সংবাদদাতা ও সতর্ককারী হিসেবে প্রেরণ করেছি।’ (সূরা আল-সাবা, আয়াত- ২৮)

পবিত্র ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী (স.)-এর গুরুত্ব এই যে, মানবজাতির মুক্তিদাতা সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (স.) ১২ রবিউল আউয়াল, ২৯ আগস্ট ৫৭০ খ্রিস্টাব্দের এ দিনে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁকে প্রেরণের উদ্দেশ্যে ছিল মানবগোষ্ঠীকে এ পৃথিবীতে পাপাচার, সন্ত্রাস, দুর্নীতিসহ সব প্রকার জুলুম, নির্যাতন ও অন্যায় অত্যাচার থেকে মুক্তিদান, সুখ-শান্তি ও সৎপথে পরিচালনা এবং মৃত্যুর পরে জাহান্নামের অগ্নি থেকে পরিত্রাণের মাধ্যমে চিরসুখময় জান্নাতের যোগ্য করে গড়া।

গোটা মানবজাতির সুদীর্ঘ প্রতীক্ষার পরই সৃষ্টির সর্বশেষ, সর্বাধিক সম্মানিত এবং সব নবী-রাসূলের সর্দার পৃথিবীতে শান্তির বাণী নিয়ে আগমন করেন। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (স.) কোনো একটি বিশেষ দল বা সমপ্রদায়ভুক্ত নবী ছিলেন না, তিনি ছিলেন সমগ্র বিশ্বের মানুষের জন্য বিশ্বনবী। কারণ তাঁর পরে দুনিয়াতে আর কোনো নবীর আবির্ভাব হবে না। এ মর্মে রাসূলুল্লাহ (স.) বাণী প্রদান করেছেন যে, ‘অন্য নবীরা তাদের স্বস্ব সম্প্রদায়ের প্রতি প্রেরিত হয়েছিলেন, আর আমি বিশ্বের সমগ্র মানবের জন্য প্রেরিত হয়েছি।’ নবী করীম (স.) বিদায় হজের ভাষণে ঘোষণা করেন, ‘আমি শেষ নবী আমার পরে আর কোনো নবী নেই।’

রাসূলুল্লাহ (স.) নবুওয়াত প্রাপ্তির পর সর্বপ্রথম পবিত্র কুরআনের আয়াতের দ্বারা বিশ্বের মানুষকে তাওহীদ তথা আল্লাহর একত্ববাদের প্রতি আহ্বান জানান, হে মানব জাতি, তোমরা বল, আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই, তাহলে তোমরা সফলকাম হবে। তিনি মানবগোষ্ঠীর প্রতি সত্য প্রচারে নিবিষ্ট হন এবং তাদেরকে সরল-সঠিক পথের দিকে পরিচালিত করেন। যাতে তারা জীবনের সফলতা অর্জনে ফলপ্রসূ হতে পারে আর ইহকালীন জীবনে শান্তি ও সৌভাগ্য লাভ করতে সক্ষম হয়।

বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (স.) এমন এক সমাজে আবির্ভূত হন যেখানে লোকেরা তাদের মানবিক গুণাবলি ও চারিত্রিক আদর্শ হারিয়ে ফেলেছিল। রাসূলুল্লাহ (স.) তাদের নিজের সুন্দর আচরণ, উত্তম চরিত্র মাধুর্যের দ্বারা মানবিক গুণাবলি ও সামাজিক মূল্যবোধের শিক্ষা দেন এবং আল্লাহর একত্ববাদের স্বীকৃতি ও তার আনুগত্যের মাধ্যমে মানবজীবনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অর্জনের পথনিদের্শনা প্রদান করেন। আত্মভোলা ও পথভ্রষ্ট মানুষকে মানব মর্যাদা, স্রষ্টা ও সৃষ্টির সম্পর্ক, মানুষের দায়িত্ব ও কর্তব্য শিক্ষা দেন। জীবন ও মরণের উপলব্ধি সৃষ্টির দ্বারা রাসূলুল্লাহ (স.) আরব সমাজে শান্তি, শৃঙ্খলা, সাম্য, মৈত্রী ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় মানব ইতিহাসে অতুলনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।

প্রতি বছর পবিত্র ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী (স.) উদযাপনের মাধ্যমে মুসলিম জাতি রাসূলুল্লাহ (স.)-এর শিক্ষা ও জীবনাচরণকে নিজেদের কর্মজীবনে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এবং নিজেদেরকে সুন্দর করে গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে নতুন করে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হন। এমনিভাবে নবচেতনার দ্বারা উজ্জীবিত হয়ে দ্বীন ইসলামের পূর্ণাঙ্গ অনুসরণের মাধ্যমে ঈমানের বলিষ্ঠতা আমলের পরিপূর্ণতা অর্জন সার্বিক সৌভাগ্য ও কল্যাণ লাভের পথ সুগম করে। কারণ মহানবী (স.)-এর শিক্ষা ও তাঁর সুন্নাতের অনুসরণ মানবজীবনের উৎকর্ষ সাধন ও সাফল্যমন্ডিত হওয়ার চাবিকাঠি। এখানে বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, রাসূলুল্লাহ (স.)-এর পবিত্র সিরাত ও তার অমূল্য শিক্ষাবলি আলোচনার মধ্যেই যেন পবিত্র ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী (স.)-এর প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে এ মহতি উপলক্ষে মহানবী হজরত মুহম্মদ (স.)-এর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা, ভক্তি ও ভালোবাসা নিজের হৃদয়ে সুদৃঢ় করা, তার রেখে যাওয়া বিধি-বিধান ও সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরার মতো ঈমানী শক্তি সঞ্চয় করা, যাবতীয় কর্মকান্ডে তার নীতি, আদর্শ ও শিক্ষা বাস্তবায়ন করা। কেননা, জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (স.)-এর অনুগত্য ও অনুসরণ করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য অপরিহার্য কর্তব্য। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ-তায়ালা তাঁর আনুগত্য ও রাসূলুল্লাহ (স.)-এর অনুসরণের নির্দেশ দিয়েছেন। এ মর্মে পবিত্র কুরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে-
‘আপনি বলুন হে রাসূল, তোমরা আল্লাহর ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করো।’

অন্য আয়াতে নির্দেশ করা হয়েছে-

‘ওহে যারা ঈমান এনেছ তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করো এবং রাসূলের আনুগত্য করো।’ আল্লাহ-তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন রাসূলুল্লাহ (স.)-এর শিক্ষা ও আদর্শ অনুসরণ ছাড়া সম্ভব নয়। কারণ রাসূলুল্লাহ (স.) যা কিছু বলেছেন অথবা যা নির্দেশ দিয়েছেন, তা ওহি বা প্রত্যাদেশের দ্বারাই করেছেন। পবিত্র কুরআনে এ মর্মে ইরশাদ হয়েছে, তিনি (রসূল) মনগড়া কিছুই বলেন না, তিনি যা বলেছেন তা প্রত্যাদেশকৃত ঐশীবাণী ছাড়া আর কিছু নয়।

এজন্যই আল্লাহ রব্বুল আলামিন আমাদের রাসূলুল্লাহ (স.)-এর আদর্শাবলি অনুসরণ ও তাঁর শিক্ষা মেনে চলার নির্দেশ প্রদান করেছেন, বলেছেন-
অবশ্যই তোমাদের জন্য রয়েছে আল্লাহর রাসূলের মধ্যে সুন্দরতম আদর্শ। (সূরা-আল-আহযাব, আয়াত-২১)
রাসূল্লাহ (স.) উত্তম চরিত্রের অধিকারী ছিলেন বলে বিরোধী কাফিররাও তাঁকে আল-আমিন তথা বিশ্বাসী উপাধিতে ভূষিত করেছিল এবং তার এই সৎচরিত্রে মুগ্ধ হয়ে দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করেছিল, আল্লাহ-তায়ালা নবীকুল শিরোমণির উত্তম চরিত্র সম্পর্কে আল-কুরআনে ঘোষণা করেন নিশ্চয়ই আপনি সুমহান চরিত্রের অধিকারী। সূরা আল-কালাম, আয়াত-৪

পবিত্র ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী (স.) আরেকটি বিশেষ তাৎপর্যময় ও গুরুত্বপূর্ণ যে, এদিনই ৬৩২ খ্রিস্টাব্দের ৭ জুন, ১১ হিজরি ১২ রবিউল আউয়াল মানবজাতির সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠতম আদর্শ আখেরি নবী হজরত মুহম্মদ (স.)-এর ওফাত দিবস। মহানবী (স.) পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন কিন্তু রেখে গেছেন হেদায়াতের পথনির্দেশনা। রাসূলুল্লাহ (স.) তাঁর ঐতিহাসিক বিদায় হজের ভাষণে বিশাল জনসমুদ্রে পবিত্র কুরআন ও হাদিস আঁকড়ে ধরার আহ্বান-

আমি তোমাদের জন্য দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি, যতদিন তোমরা এর অনুশাসন মেনে চলবে, ততদিন তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না। এ দুটি জিনিস হলো : আল্লাহর কিতাব, আল-কুরআন এবং তাঁর প্রেরিত রাসূলের চরিত্রাদর্শ আল-হাদিস। (মিশকাত)
বর্তমান সমস্যাসংকুল বিশ্বে যেখানে মানুষ মৌলিক মানবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, যেখানে সন্ত্রাস ব্যাপক আকার ধারণ করেছে, দেশে দেশে হানাহানি ও যুদ্ধ-বিগ্রহ চলছে, নিরীহ মানুষের রক্ত ঝরছে, যেখানে আন্তধর্মীয় সম্প্রীতি ও সৌহার্দ বিনষ্ট হচ্ছে, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় মতপার্থক্য ও আচার-আচরণের বিভিন্নতা সহ্য করা হচ্ছে না, সেখানে রাসূলুল্লাহ (স.)-এর অনুপম আদর্শ ও সার্বজনীন শিক্ষা অনুসরণই বহু প্রত্যাশিত শান্তি ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করতে পারে।

রসূলুল্লাহ (স.)কে আল্লাহ তাআলা সমগ্র জাহানের জন্য রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছেন বলে স্বয়ং পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘ওয়ামা আরসালনাকা ইল্লা রাহমাতাল লিল আলামীন।’ সকল সীরাত গ্রন্থে রসূলুল্লাহ (স.) এর দুনিয়ায় আগমনের খবরে আবু লাহাবের প্রতিক্রিয়ার ঘটনাটি উল্লেখিত হয়েছে। এ সম্পর্কে হযরত শায়খ আব্দুল হক মোহাদ্দেস দেহলবী (র.) এর বর্ণনাটি বিশেষভাবে প্রনিধানযোগ্য। তিনি বলেন: আবু লাহাবের বান্দীগণের মধ্যে সোওয়াইবা রসূলুল্লাহ (স.) এর ভূমিষ্ট হবার সুসংবাদটি আবু লাহাবকে পৌঁছান। খবরটি শুনে আবু লাহাব বান্দী সোওয়াইবাকে মুক্ত করে দেন। আবু লাহাবের মৃত্যুর পর তার কোনো সঙ্গী তাকে স্বপ্নযোগে দেখেন এবং তার কী অবস্থা জিজ্ঞাসা করেন। আবু লাহাব জবাবে বলেন, ‘জাহান্নামে পড়ে রয়েছি, তবে এতটুকু অবশ্যই হয়েছে যে, প্রতি সোমবার রাতে আযাব কিছুটা হ্রাস করা হয়। আবু লাহাব তার দুই আঙ্গুলের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন যে, এই আঙ্গুলদ্বয়ের ইঙ্গিতে আমি সোওয়াইবাকে ঐ কারণে আজাদ করেছিলাম যে, সে রসূলুল্লাহ (স.) এর জন্মলাভের সুসংবাদ জানিয়েছিল। এর বিনিময়ে ঐ দুই আঙ্গুল দ্বারা কিছু পানি পান করি। সোওয়াইবা সম্পর্কে আবু লাহাব বলেন, সে আমার আজাদকৃত বান্দী (দাসী) ছিল, রাসূলুল্লাহ (স.)কে সে দুধও পান করিয়েছিল।

শায়খ আব্দুল হক মোহাদ্দেস দেহলবী (র.) বলেন: সোওয়াইবাকে আজাদ করে আবু লাহাব এই বিনিময় লাভ করে যে, দোজখে অবস্থান করেও সে সপ্তাহে এক রাতের জন্য আনন্দ খুশি লাভ করে। যদি তাই হয় তবে সেসব মুসলমানের অবস্থা চিন্তা করা যায়, যারা রসূলুল্লাহ (স.) এর জন্মোৎসব উপলক্ষে আনন্দ-উল্লাস প্রকাশ করে এবং তার মহব্বত-ভালবাসায় ক্ষমতানুযায়ী ব্যয় করে। আমার প্রাণের শপথ: রসূলুল্লাহ (স.) এর জন্মরজনীতে আনন্দ প্রকাশের কারণে আল্লাহতায়ালা তার সাধারণ দয়া-অনুগ্রহে আনন্দ প্রকাশকারীগণকে বেহেশতের বাগানে দাখিল করবেন। মুসলমনগণ সব সময় মিলাদ-মাহফিলের আয়োজন করে আসছেন। মিলাদ মাহফিলের সঙ্গে সঙ্গে দাওয়াত করে থাকেন, খাওয়ার ব্যবস্থা করেন এবং গরিব-দরিদ্রদের নানা রকমের উপহার-উপঢৌকন দিয়ে থাকেন। তারা আনন্দ প্রকাশ করেন এবং অকাতরে খরচও করেন। এতদ্ব্যতীত জন্মোৎসব উপলক্ষে কুরআন খতম করান এবং নিজেদের আবাসগৃহ সুসজ্জিত করেন। এসব উত্তম কাজের বরকতে ঐসব লোকের উপর আল্লাহর বরকত-রহমত হতে থাকে।

শায়খ আব্দুল হক মোহাদ্দেস দেহলবী (র.) ইবনে জওযীর বর্ণনা উদ্ধৃত করে বলেন: মিলাদ-মাহফিল আয়োজনকারীদের জন্য বিশেষ অভিজ্ঞতা হচ্ছে যে, মীলাদ অনুষ্ঠানকারীরা সারা বছর আল্লাহর আশ্রয়ে নিরাপদে থাকে এবং উদ্দেশ্য ও মকসুদ হাসিলের আনন্দ তাড়াতাড়ি উপভোগ করতে পারে। আল্লাহ তাআলা রহমত নাজিল করেন মিলাদুন্নবীর রাতে যারা ঈদোৎসব পালন করে তাদের প্রতি। আর যাদের অন্তরে হঠকারিতা থাকে, তাদের অন্তর সে কাজে আরও শক্ত হয়ে যায়। আল্লামা কুসতুলানী রাসূলুল্লাহ (স.) এর জন্ম রবিউল আউয়াল মাস- এই মতের সমর্থনে লিখেছেন যে, তাঁর জন্মতারিখে মক্কাবসীরা নিয়মিত জন্মস্থান জিয়ারত করত। তার এ উক্তি হতে প্রমাণিত হয় যে, রাসূলুল্লাহ (স.) এর জন্মতারিখে মক্কাবাসীরা তাঁর জন্মস্থান জিয়ারত করত। এটি ওফাতের পূর্বের ঘটনা হওয়াই স্বাভাবিক। অর্থাৎ তাঁর জীবদ্দশায় মক্কী জীবনে মুসলমানগণ হজরতের জন্মস্থানের প্রতি সম্মান প্রদর্শনার্থে এরূপ করে থাকতো। এখানে প্রশ্ন হচ্ছে যে, মক্কায় হজরতের জন্ম হয় কোন স্থানে? এ সম্পর্কে হজরত থানভী (র.) তিনটি মতের কথা উল্লেখ করেছেন, শোয়াব, রাদম ও আসফান। যা হোক, এ ঘটনা মিলাদোৎসবের এক বড় দলিল। রসূলুল্লাহ (স.) এর নবুওয়াত প্রাপ্তির পূর্বের এসব ঘটনা তাঁর জন্মোৎসব বা ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপনের প্রকৃষ্ট প্রমাণ। সুতরাং বিশ্বনবী হজরত মোহাম্মদ (স.) এর উম্মতের পক্ষ হতে তাঁর জন্মোৎসব অর্থাৎ ঈদে মিলাদুন্নবী পালন করার প্রয়োজন ও গুরুত্ব অস্বীকার করার উপায় নেই। এ প্রসঙ্গে রসূলুল্লাহ (স.) এর আপন চাচা হযরত আব্বাস (রা.) ইবনে আব্দুল মোত্তালেবের একটি ঘটনা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ঘটনাটি হাকিুমল উম্মত হযরত মওলানা আশরাফ আলী থানভী (র.) তার ‘নাশরুত্তীব’ পুস্তকে উল্লেখ করেছেন, যেখানে তিনি হুজুর (স.) এর অনুমতিক্রমে প্রশস্তিসূচক একটি কাসিদায় তার জন্মবৃত্তান্ত বর্ণনা করেছেন। এ সম্পর্কে থানভী (র.) বলেছেন: রসূলুল্লাহ (স.) যখন তাবুক যুদ্ধ হতে মদীনায় প্রত্যাবর্তন করেন, তখন হজরত আব্বাস (রা.) আরজ করেলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল, আমাকে আপনার কিছু প্রশংসা করার অনুমতি দান করুন।’ (যেহেতু হুজুর (স.) এর প্রশংসা করা স্বয়ং আনুগত্য তাই), তিনি এরশাদ করেন, ‘বল আল্লাহ তোমার জবানের হেফাজত করুন।’ তখন হযরত আব্বাস (রা.) হুজুর (স.) এর প্রশংসায় আটটি কবিতা সম্বলিত একটি কসীদা পাঠ করেন। এসব কবিতায় হুজুর (স.) এর জন্মবৃত্তান্ত বর্ণিত হয়েছে। তিনি স্বয়ং এই কাসিদা শ্রবণ করেন। মূল কাসিদাটি হযরত থানভী (র.) এর উলেখিত পুস্তকে উদ্ধৃত হয়েছে।

এই ঘটনা হতে আরো প্রমাণিত হয় যে, রসূলুল্লাহ (স.) এর জন্মোৎসব পালন করার সময় তাঁর জীবনচরিত, আদর্শ ও শিক্ষা আলোচনা করা একান্ত আবশ্যক। তবে এরূপ আলোচনা বা মীলাদ মাহফিল কেবল তাঁর জন্মদিবস বা জন্মমাসেই সীমাবদ্ধ নয়, সর্বদাই তা করা উচিত। আরো উল্লেখ্যযোগ্য যে, হযরত হাসসান ইবনে সাবেত (রা.) ছিলেন একজন সাহাবী কবি। তার উপাধি ছিল ‘শায়েরুননবী’। তিনি রসূলুল্লাহ (স.) এর উপস্থিতিতে তাঁর প্রশংসায় বহু কবিতা আবৃত্তি করেন। মীলাদুন্নবী উদযাপন উপলক্ষে হুজুর (স.) এর জীবনচরিত আলোচনা করার তাৎপর্য এতে সহজেই অনুমেয়।

আল্লাহর নামের সাথে যার নাম অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত, যাঁর স্মরণকে স্বয়ং আল্লাহতাআলা সুমহান করেছেন, মাকামে মাহমুদ যাঁকে দান করেছেন, আল্লাহ তাঁর মর্যাদা সুউচ্চ করেছেন, তাঁর জন্মোৎসব-ঈদে মীলাদুন্নবী উদযাপন করার গুরুত্ব ও প্রয়োজন সর্বাধিক, একথা বলার অপেক্ষা রাখে না। পবিত্র কুরআনের অসংখ্য আয়াতে আল্লাহর আনুগত্যের সাথে তাঁর রাসূলের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের নির্দেশ রয়েছে। তাঁর প্রতি ভালবাসা, আল্লাহর প্রতি ভালবাসা স্বরূপ। যাঁর মধ্যে উত্তম আদর্শ, পবিত্র কোরআন যার মহান চরিত্র এবং যার প্রতি খোদ আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতাগণ দরূদ পাঠ করে থাকেন, তার জন্মোৎসব উদযাপন করার সৌভাগ্য আল্লাহর এক মহান অবদান। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনের একটি আয়াতে আল্লাহতাআলা বলেন: ‘এবং আমি আপনার জন্য আপনার স্মরণকে সমুন্নত করেছি।’ (সূরা -ইনশেরাহ, আয়াত-৪)
এই আয়াতের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কুরআনের ভাষ্যকারগণ বহু মূল্যবান তথ্য পরিবেশন করেছেন, যা একত্রিত করা হলে এক বিরাট গ্রন্থ হয়ে যাবে। কতিপয় হাদীসের আলোকে এখানে ব্যাখ্যার সার সংক্ষেপে প্রদত্ত হল:

ইবনে হাব্বান তার গ্রন্থে হযরত আবু সাঈদ (রা.) হতে বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ (স.) আয়াতটি সম্পর্কে হযরত জিবরাইল (আ.)কে জিজ্ঞাসা করলেন। তিনি বললেন, আল্লাহ এরশাদ করেন: ‘ইযা যুকিরতু যুকিরতা মায়ী’ আপনার স্মরণকে সমুন্নত করার অর্থ হচ্ছে, যখন আমাকে স্মরণ করা হয়, আমার সাথে আপনাকেও স্মরণ করা হয়। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেছেন যে, আয়াতের অর্থ হচ্ছে আযানে তাকবীরে, তাশাহুদে মিম্বরসমূহের উপর, খোৎবাসমূহে। সুতরাং যদি কেউ আল্লাহ-তাআলার এবাদত করে এবং প্রত্যেক কথায় তাঁর সত্যতা স্বীকার করে কিন্তু রাসূলুল্লাহ (স.) এর রেসালতের সাক্ষ্য না দেয়, তাহলে তার এসব আমল নিষ্ফল। সে কাফেরই থেকে যাবে। হযরত কাতাদাহ (রা.) বলেছেন যে, আল্লাহ-তাআলা তাঁর স্মরণকে দুনিয়া ও আখেরাতে বুলন্দ করেছেন- প্রত্যেক বক্তা, প্রত্যেক তাশাহুদ পাঠকারী-আশহাদু আল্লা ইলাহা-ইল্লাল্লাহুর সাথে আশহাদু আন্না মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহও উচ্চারণ করে থাকে। কোনো কোনো তফসীরকারের মতে, রসূলুল্লাহ (স.) এর স্মরণের উচ্চ মর্যাদা হচ্ছে, আল্লাহ তাআলা সম্মানিত নবীগণ (আ.) থেকে তাঁর উপর ঈমান আনার জন্য ওয়াদা নিয়েছেন।

কেবল বিশ্বজগতে রসূলুল্লাহ (স.) এর স্মরণ সীমাবদ্ধ নয়, যার কিছুটা বিবরণ উপরে বর্ণিত হয়েছে, এমনকি ‘আলমে গায়ব’ বা অদৃশ্য জগতেও তাঁর নাম অহরহ স্মরণ করা হচ্ছে। আলমে গাইবের তিনি হচ্ছেন সুলতান, কোনো স্থান মহল এমন নেই, যেখানে তাঁকে উত্তমরূপে স্মরণ করা হয় না, তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা না হয়। তাঁকে স্মরণ করা হয় কবরে, হাশরে এবং ফেরেশতাগণও জিজ্ঞাসা করেন মোহাম্মদ (স.) এর আনুগত্য স্বীকার করেছিল কি’না, তাঁর অবাধ্য ছিল কি’না? তাঁর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছিল কি’না? জান্নাতের দ্বারসমূহে এবং আরশের উপরও তাঁর নাম লিপিবদ্ধ রয়েছে। অনুকূল, প্রতিকূল এমন কোনো তারিখ নেই, যাতে রাসূলুল্লাহ (স.)কে স্মরণ করা হয় না। অস্বীকারকারীরাও তাঁর প্রশংসা না করে পারে না, সমগ্র জগতে এমন কোনো স্থান নেই, যাতে তাঁকে স্মরণ করা হয় না। এর চেয়ে সুউচ্চ সম্মান আর কী হতে পারে? আল্লামা আব্দুল হক হক্কানী তার তফসীরে এসব বিষয় উল্লেখ করে বলেন যে, রসূলুল্লাহ (স.) এর সমুন্নত স্মরণকে একটি সুউচ্চ প্রাসাদের সাথে তুলনা করা যায়। দ্বাদশ কক্ষ বিশিষ্ট এই প্রাসাদের প্রত্যেকটির পরিচালকই তিনি।

মোট কথা, রসূলুল্লাহ (স.) এর গুণাবলী বর্ণনা ও প্রশংসা বলে শেষ করা যাবে না। তাই জন্ম দিবস পর্যন্ত তাঁর স্মরণ এ আলোচনা সীমাবদ্ধ করে তাঁর সুমহান মর্যাদাকে খাটো করা যায় না, বরং সারা বছরই তাঁকে স্মরণ ও জীবনী আলোচনা করা যায়। এর মধ্যে রয়েছে সর্বপ্রকারের কল্যাণ।
ঈদে মীলাদুন্নবী উপলক্ষে মিলাদ-মাহফিলের অনুষ্ঠান করা, দান-খয়রাত এবং আনন্দ প্রকাশ করার বৈধতা সম্পর্কে সাহাবায়ে কিরামের আমল রয়েছে বলে যারা মনে করেন, তারা এর সমর্থনে আল্লামা ইমাম শাহাবুদ্দীন আহমদ ইবনে হাজার আল হায়তামী শাফেয়ীকৃত ‘আন নেমাতুল কোবরা আলাল আলমে ফি মওলাদে সাইয়িদিল আনাম’ গ্রন্থের ৭ম পৃষ্ঠার বরাত দিয়ে বলেছেন যে, খোলাফায়ে রাশেদীন এ ব্যাপারে যেসব মন্তব্য করেছেন তা নিম্নরূপ: ১. প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) বলেছেন: যে ব্যক্তি হুযুর (স.) এর মিলাদ শরীফে এক দেরহাম বা টাকা ব্যয় করবে, সে আমার সাথে বেহেশতে অবস্থান করবে। ২. দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর (রা.) বলেছেন: যে ব্যক্তি হুযুর (স.) এর মিলাদ শরীফকে ইজ্জত বা সম্মান করে সে যেন ইসলামকে পূর্ণজ্জীবিত করল। ৩. তৃতীয় খলিফা হযরত ঊসমান (রা.) বলেছেন: যে ব্যক্তি রসূলুল্লাহ (স.) এর মিলাদ শরীফ উদযাপন করতে গিয়ে দেরহাম বা টাকা-পয়সা ব্যয় করবে, সে যেন বদর, হুনাইনের মতো মহান যুদ্ধে অংশগ্রহণ করল। ৪. চতুর্থ খলিফা হযরত আলী মুরতাজা (রা.) বলেছেন: ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপনকারী ঈমানের সঙ্গে মৃত্যুবরণ করবে। ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপনের পক্ষে অনুরূপ আরও বহু মূল্যবান মন্তব্য থাকলেও এ সম্পর্কে ভিন্ন মতামতও রয়েছে। তবে রাষ্ট্রীয়, জাতীয়ভাবে আমাদের দেশেও যথার্থ ধর্মীয় মর্যাদা সহকারে দিবসটি পালিত হয়ে থাকে।

রসূলুল্লাহ (স.)কে সোমবারের দিন রোযা রাখা সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। উত্তরে তিনি বলেন, তোমরা সোমবার রোযা রাখ, কারণ ঐদিন আমি জন্মগ্রহণ করেছি এবং ঐদিন আমার প্রতি কুরআন নাযিল করা হয়েছে। মূল হাদীসটি হচ্ছে: ‘সুয়েলা রসূলুল্লাহ (স.) আন সাওমিল ইসনাইনে ফা’কালা ফিহি উলিদতু ওয়াফিহি উনজিলা আলাইয়্যাল কুরআন।’ এই হাদীস দ্বারা রাসূলুল্লাহ (স.) এর জন্মদিবসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য সহজেই অনুমিত হয়।

পবিত্র ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী (স.) আমাদের সবার মনে সহনশীলতা, সংযম, হৃদ্যতা, সম্প্রীতি, পারস্পরিক ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা সৃষ্টিতে সহায়ক হোক। -ছুম্মা আমিন

শেয়ার করুন

© All rights reserved © 2017
Developed By

Shipon