আজ বুধবার, ১৫ জানুয়ারী ২০২৫, ০৮:৪৬ অপরাহ্ন
খোকন আহম্মেদ হীরা ॥
বরিশাল জেলার বিভিন্ন উপজেলায় কোনভাবেই বাল্যবিবাহ বন্ধ করা যাচ্ছেনা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাল্যবিবাহ বন্ধ করার পর পরই গোপনে বাড়িতে কিংবা অন্যত্র নিয়ে মেয়েকে বাল্যবিবাহ দিচ্ছেন অভিভাবকরা। বিগত একবছরে জেলার দশটি উপজেলায় যেসব বাল্যবিবাহ বন্ধ করা হয়েছিলো তার ৭০ শতাংশই পরে বিয়ে হয়ে গেছে। অভিভাবকদের অসচেতনতা ও নোটারীর মাধ্যমে বিয়ের কাজ সম্পন্ন করায় কোনক্রমেই বাল্যবিয়ে ঠেকানো যাচ্ছেনা। পাশাপাশি বাল্যবিয়ে বন্ধ করার পরে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের পক্ষ থেকে আর কোন খোঁজ না নেয়ার কারণেও বাল্যবিয়ে ঠেকানো যাচ্ছেনা বলে মত দিয়েছেন সচেতন বরিশালবাসী।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চলতি বছরের ৩১ আগস্ট জেলার উজিরপুর উপজেলার বড়কোঠা ইউনিয়নের নরসিংহা গ্রামের মোহাম্মদ শরীফ খানের স্কুল পড়–য়া কিশোরী কন্যা সামিয়া আফরিনের (১৫) বাল্যবিয়ের খবর পেয়ে তা বন্ধ করে দিয়েছিলেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার। ওইসময় কিশোরী সামিয়ার পরিবারের কাছ থেকে লিখিত মুচলেকা নেওয়া হয়েছিলো। কিন্তু গত ২৩ সেপ্টেম্বর কৌশলে কিশোরী সামিয়াকে তার অভিভাবকরা বিয়ে দিয়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জনৈক রুমা বেগমের মধ্যস্থতায় পাশ্ববর্তী বানারীপাড়া উপজেলার বীর মুক্তিযোদ্ধা কাঞ্চন মহাজনের ছেলে নাঈম মহাজনের সাথে সামিয়া আফরিনের বিয়ে হয়। বিষয়টি এলাকায় ছড়িয়ে পরলে গ্রামবাসীর মধ্যে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে।
নরসিংহা গ্রামের একাধিক বাসিন্দারা বলেছেন, যেখানে প্রশাসন বাঁধা দিয়ে ও লিখিত মুচলেকা নিয়েও বাল্যবিয়ে আটকাতে পারেননি, সেখানে শুরুতেই বাঁধা দেওয়ার কি প্রয়োজন ছিলো। তারা আরও জানিয়েছেন, কিশোরী সামিয়ার অমতে তার পরিবারের সদস্যরা প্রশাসনের বাঁধাকে উপেক্ষা করে বাল্যবিয়ে দেওয়ার ঘটনায় এলাকার অন্যান্য অসচেতন অভিভাবকরা এখন উৎসাহ পেয়েছে। তাই ওই এলাকায় ভবিষ্যতে বাল্যবিয়ে বন্ধ করতে হলে এখনই লিখিত মুচলেকার সূত্রধরে কিশোরী সামিয়ার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য সচেতন এলাকাবাসী জোর দাবি করেছেন। একইসাথে একজন সচেতন নাগরিক বীর মুক্তিযোদ্ধা কিভাবে অপ্রাপ্ত বয়সের এক কিশোরীকে তার ছেলের জন্য পুত্রবধূ হিসেবে গ্রহণ করেছেন সেবিষয়টিও খতিয়ে দেখা উচিত।
সচেতন নাগরিক কমিটির বরিশাল জেলার সদ্য সাবেক সভাপতি নারীনেত্রী প্রফেসর শাহ্ সাজেদা সাংবাদিকদের বলেন, অধিকাংশ বাল্যবিয়ের ক্ষেত্রে দেখা গেছে বিয়ের কয়েকবছর যেতে না যেতেই বিচ্ছেদ হয়ে যাচ্ছে। তাই প্রথমতো অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। তিনি আরও বলেন, শুধু প্রশাসন কিংবা বেসরকারি সংস্থা দিয়ে বাল্যবিবাহ বন্ধ করা কঠিন বিষয়। বরিশালে সপ্তম থেকে দশম শ্রেণির ছাত্রীরা বেশি বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছে। তাই সবার আগে প্রতিদিন শ্রেণিকক্ষে বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে ছাত্র-ছাত্রীদের সচেতন করতে হবে। পাশাপাশি বাল্যবিয়েরোধে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে আরো কঠোর হতে হবে। গোপনে কেউ বাল্যবিবাহ দিলে কিংবা আয়োজন করলে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
নামপ্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা বলেন, বাল্যবিবাহ মুচলেকা কিংবা জরিমানা করে বন্ধ করা যাচ্ছেনা। বন্ধ করার পর অভিভাবকরা গোপনে অন্যস্থানে নিয়ে তাদের অপ্রাপ্ত মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন। পাশাপাশি বাল্যবিবাহ বন্ধের পর যাতে ১৮ বছর বয়সের আগে বিয়ে দিতে না পারে সেজন্য তদারকির প্রয়োজন। এজন্য অধিকাংশ ইউনিয়নে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে যে কমিটি রয়েছে তা গতিশীল নয়।
এছাড়া মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের লোকবল খুবই কম। যানবাহন নেই। বাল্যবিবাহ বন্ধের জন্য নেই কোনো বরাদ্দ। অনেক ক্ষেত্রে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বাল্যবিবাহ বন্ধে সহযোগিতা করাতো দূরের কথা বরং তারাও নানাভাবে বাল্যবিয়ের সাথে জড়িয়ে পরেন। যেকারণে বাল্যবিয়ে বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছেনা।