আজ শুক্রবার, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:৪১ পূর্বাহ্ন

Logo
হামাস’র এক ঝাঁকুনিতে শক্তিশালী ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তছনছ!

হামাস’র এক ঝাঁকুনিতে শক্তিশালী ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তছনছ!

 

হামাস’র এক ঝাঁকুনিতে শক্তিশালী ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তছনছ!

পল্লী জনপদ ডেস্ক॥

ফিলিস্তিনের সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস যখন গাজার কাছাকাছি ইসরায়েলের এলাকার ভেতরে দীর্ঘ ধরে ইচ্ছামতো ঘোরাফেরা করছিল, ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী তখন কোথায় ছিল? অনেকেই এখন এই প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন। যেমন একজন ইসরায়েলি অভিযোগ করেছেন “ইসরায়েলের সেনাবাহিনী দ্রুত জবাব দিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে।” যেসব এলাকায় হামাস হামলা চালিয়েছে সেখানকার বাসিন্দাদের সেনাবাহিনীর আসার জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে। যদিও এই সময় তারা নিরাপত্তার জন্য নিজেদের বেসামরিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ওপরেই নির্ভর করেছেন।

এরকম কেন হল? এই প্রশ্নের পূর্ণাঙ্গ উত্তর পেতে হয়তো আরও সময় লাগবে। কিন্তু এই হামলার ঘটনায় মনে হচ্ছে যে, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী এ ধরনের আকস্মিক, দ্রুত গতির ও বড় পরিসরের হামলায় হতচকিত হয়ে গিয়েছিল। তারা যে পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে সেটি প্রতিরোধের জন্য তাদের যথেষ্ট প্রস্তুত ছিল না।

এ ধরনের আক্রমণ সফল করতে হলে হামাসের জন্যও এমন আকস্মিক হামলা চালানোই একমাত্র উপায় ছিল। হামাসের এই হামলার পরিকল্পনার বিষয়ে জানতে ইসরায়েলি গোয়েন্দারাও ব্যর্থ হয়েছে। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, ইসরায়েলকে বিভ্রান্ত করতে এই গোষ্ঠী বহুদিন ধরেই এমন আচরণ করে আসছিল যে, তারা পরিকল্পিত হামলা চালাতে অক্ষম বা তাদের ইচ্ছা নেই।

তারা সম্ভবত ইলেকট্রনিক মাধ্যমে সব ধরণের যোগাযোগ বন্ধ রাখা অনুশীলন করেছিল। যার কারণে তাদের অভিযানের গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে। সেই সঙ্গে তারা সম্ভবত ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার না করায় অভিযানের গোপনীয়তা বজায় রাখতে পেরেছে। এরপর হামাস গুরুত্ব দিয়েছে দ্রুত গতির আর বড় পরিসরে হামলা চালানোর ওপর। নিজেদের এসব কর্মকাণ্ড আড়াল করতে তারা ইসরায়েলে হাজার হাজার রকেট উৎক্ষেপণ করেছে।

ইসরায়েলে কী ঘটছে তা নজরদারির জন্য সীমান্ত বেষ্টনীতে যেসব পর্যবেক্ষণ সরঞ্জাম ব্যবহার করা হতো সেগুলোর ওপরও ড্রোন হামলা চালানো হয়েছে। এরপর বিস্ফোরক এবং যানবাহন ব্যবহার করে নিরাপত্তা বেষ্টনীর অন্তত ৮০টি জায়গা ভেঙে তারা ইসরায়েলে প্রবেশ করে। এসব কাজে মোটর চালিত হ্যাং-গ্লাইডার অর্থাৎ অনেকটা প্যারাসুটের মতো দেখতে মানববাহী বাহন এবং মোটরবাইকও ব্যবহার করা হয়। এভাবে গাজা থেকে ৮০০ থেকে এক হাজার সশস্ত্র হামাস সদস্য একাধিক স্থানে আক্রমণ চালাতে শুরু করে এবং ছড়িয়ে পড়ে।

হামাসের এমন ঝাঁক বেধে প্রবেশের কৌশল ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ভেঙে ফেলতে সফল হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে- অন্তত কিছু সময়ের জন্য হলেও। এই বড় পরিসরের কার্যকলাপ ইসরায়েলের নেতৃত্ব এবং নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রগুলোর মধ্যে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে দেয়ার কথা। কিন্তু একে তো শনিবার সকাল তার ওপর ধর্মীয় ছুটির দিন হওয়ায়, সেদিন পরিবেশ আগে থেকেই শান্ত ছিল।

হামাস যোদ্ধাদের মধ্যে একটি অংশ বেসামরিক মানুষদের লক্ষ্য করে হামলা চালায় এবং অন্যরা সামরিক ফাঁড়িগুলো লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে।ইসরায়েলি ট্যাঙ্কগুলো দখল করে হামাস সদস্যদের ছবি পোস্ট করা আর সামরিক ঘাটিগুলো সহজে দখল করে নেয়ার ঘটনা প্রমাণ করে যে, এসব ঘাটির নিরাপত্তা ব্যবস্থা কতটা ঠুনকো ছিল।

সেই সাথে সীমান্তের সুড়ঙ্গগুলো দীর্ঘক্ষণ খোলা অবস্থায় ছিল যাতে জিম্মিদের গাজায় নিয়ে যাওয়া যায় এবং শেষ পর্যন্ত ওই সুড়ঙ্গগুলো বন্ধ করার জন্য ট্যাঙ্ক ব্যবহার করা হয়। পুরো ঘটনায় ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অগোছালো বলে মনে হয়েছে। ইসরায়েলি নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা বাহিনী সাম্প্রতিক মাসগুলোতে গাজার পরিবর্তে পশ্চিম তীরের দিকে বেশি নজর দিয়েছে। সেখানে একটা শূন্যতার তৈরি হয়েছে।

ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর নানা নীতির কারণে ইসরায়েলি সমাজে যে বিভক্তির সৃষ্টি হয়েছে, নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে বিভ্রান্ত করতে সম্ভবত সেটাও বিবেচনায় নিয়েছে হামাস। ইসরায়েলের সামরিক ও গোয়েন্দাদের দীর্ঘ সময় ধরে মধ্যপ্রাচ্যের সেরা এবং বিশ্বের অন্যতম সেরা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু তারা হয়তো তাদের প্রতিপক্ষের ক্ষমতাকে খাটো করে দেখেছিল।

হামাসের এই হামলাকে যুক্তরাষ্ট্রে ৯/১১ হামলার সাথে তুলনা করা হচ্ছে, যখন কেউ ধারণাও করতে পারেনি যে যাত্রীবাহী বিমানগুলোকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। একে প্রায়ই ‘ফেইলিওর অফ ইমাজিনেশন’ বা ‘চিন্তার ব্যর্থতা’ বলেও অভিহিত করা হয়। এমন ‘চিন্তার ব্যর্থতা’ ইসরায়েলের জন্য অন্যতম সমস্যা হয়ে দাঁড়াতে পারে। এতে করে তারা শত্রুপক্ষের এমন বড় ধরণের হামলা মোকাবিলার জন্য অপ্রস্তুত হয়ে পড়বে।

পুরো ঘটনায় যেসব ফাঁকফোকর বা দুর্বলতার জায়গা আছে সেগুলো নিশ্চয়ই ভবিষ্যতে তদন্ত করে দেখা হবে। কিন্তু এই মুহূর্তে পিছনে ফিরে তাকানোর পরিবর্তে সামনে কী করা যেতে পারে সেদিকেই গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। এদিকে, ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, “তারা গাজায় অভিযান চালাতে প্রস্তুত” এবং এর অংশ হিসেবে গাজা সীমান্তে লাখ লাখ সেনা মোতায়েন করা হয়েছে।

ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী- আইডিএফ এর মুখপাত্র জোনাথন কনরিকাস বলেন, গাজার চারপাশে প্রতিবন্ধকতা পুনরায় স্থাপন করা হয়েছে। গাজা সীমান্তের কাছে “পদাতিক, সাঁজোয়া সেনা, আর্টিলারি সৈন্যদল পাঠানো হয়েছে”। সেই সাথে আরো প্রায় তিন লাখ সংরক্ষিত সেনা মোতায়েন করা হয়েছে।

তিনি বলেন, সামরিক বাহিনী গাজা উপত্যকার কাছাকাছি রয়েছে এবং ইসরায়েলি সরকার তাদেরকে যে মিশন দিয়েছে তা সম্পন্ন করতে প্রস্তুত হচ্ছে। এই লড়াইয়ের শেষে ভবিষ্যতে ইসরায়েলি বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা করার মতো হামাসের যাতে আর কোন সামরিক সক্ষমতা অবশিষ্ট না থাকে তা নিশ্চিত করাই এই মিশনের লক্ষ্য।

লেবানন থেকে হামলা :

বুধবার দুপুরে ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে সামরিক বাহিনীর সাইরেন বাজানো হয়েছে বলে জানিয়েছে আইডিএফ। সংস্থাটি জানিয়েছে, গাজা ছাড়াও লেবানন থেকে সীমান্ত এলাকায় ইসরায়েলের সামরিক পোস্ট লক্ষ্য করে একটি ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়েছে।

আইডিএফ বলছে, ট্যাংক বিধ্বংসী ওই ক্ষেপণাস্ত্রটি আরব আল-আরামশি নামে একটি গ্রামের কাছে আঘাত হেনেছে। হামাস ইসরায়েলের যে অংশে হামলা চালিয়েছে এই গ্রামটি একেবারে তার বিপরীতে দেশটির আরেক প্রান্তে অবস্থিত।

সাম্প্রতিক সময়ে লেবানন সীমান্তে এটাই প্রথম সহিংসতা নয়। হেজবুল্লাহ হচ্ছে ইরান সমর্থিত লেবাননের একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী। ইসরায়েল ও বেশিরভাগ পশ্চিমা দেশগুলো ওই গোষ্ঠীকে নিষিদ্ধ করেছে। হামাস হামলা চালানোর পর থেকেই এই গোষ্ঠীটিও ইসরায়েলে হামলা চালানো শুরু করেছে। বুধবার সকাল থেকে ইসরায়েল-লেবানন সীমান্তে সহিংসতার মাত্রা বেড়ে গেছে।

লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হেজবুল্লাহ বলেছে, চলতি সপ্তাহে স্কিরমিশে ইসরায়েলের কাছে তিন জন যোদ্ধা হারানোর প্রতিশোধ হিসেবে ইসরায়েলি সেনা পোস্ট লক্ষ্য করে দুটি ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে তারা। এর প্রতিক্রিয়ায় লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলে গোলা নিক্ষেপ করে চলেছে ইসরায়েল।

লেবাননের জাতীয় সংবাদ সংস্থা তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, “ধায়রা এলাকার আশপাশের এলাকায় গোলা ছুড়েছে শত্রুপক্ষ এবং ইয়ারিন এলাকার কাছাকাছি এলাকায় ফসফরাস শেল নিক্ষেপ করা হয়েছে।” এদিকে, ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলেও সাইরেন বাজার শব্দ শোনা গেছে। সম্ভাব্য আক্রমণের বিষয়ে ইসরায়েলিদের সতর্ক করতেই এই সাইরেন বাজানো হয়।

ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলা :

মঙ্গলবারই গাজায় অবস্থিত ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অংশ ইসরায়েলি বিমান হামলায় ধ্বংস হয়ে গেছে। এক্স, যা আগে টুইটার নামে পরিচিত ছিল, সেখানে পোস্ট করা এক বার্তায় ইসরায়েলি বিমান বাহিনী নিশ্চিত করেছে যে, তারা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলা চালিয়েছে।

ইসরায়েলি বিমান বাহিনী-আইএএফ বলেছে, তারা বিশ্ববিদ্যালয়টিতে হামলা চালিয়েছে কারণ এটি “হামাসের প্রকৌশলের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়”। এছাড়া এটি “রাজনৈতিক এবং সামরিক শক্তির গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রও” বটে। এই স্থাপনা ব্যবহার করে হামাস অস্ত্র উৎপাদন করতো বলেও তারা দাবি করেছে।

ইসরায়েলে হতাহত :

গাজা থেকে ইসরায়েলে হামাসের হামলার চালানোর চার দিন পরও ইসরায়েলি কর্মীরা সেডেরত শহর থেকে এখনো মরদেহ সরিয়ে নিচ্ছে। স্থানীয় একটি পুলিশ স্টেশনে যেখানে বন্দুক যুদ্ধ হয়েছিল সেখান থেকে মরদেহ সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। ইসরায়েলে নিহতদের সংখ্যা ১২০০ তে দাঁড়িয়েছে। এদের মধ্যে বেশিরভাগই বেসামরিক নাগরিক। আহত হয়েছে ২৭০০ বেশি মানুষ।

সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র কনরিকাস বলেন, বিব্বুৎজ কাফার আজা এলাকাসহ “অবর্ণনীয় নৃশংসতা” সামনে এসেছে। এই স্থান থেকেই গতকাল বিবিসির সাংবাদিক রিপোর্ট করেছিল। কনরিকাস নৃশংসতার চিত্রকে “কোন জম্বি কিংবা ধ্বংসযজ্ঞের কোন সিনেমার দৃশ্যের সাথে তুলনা করেছেন।”

হামাসের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্র :

গাজা উপত্যকায় হামাসের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি বিমান বাহিনী আকাশপথে হামলা অব্যাহত রেখেছে। বুধবার সকালে তারা জানিয়েছে যে, এর আগের ২৪ ঘণ্টায় সাড়ে চারশ স্থাপনা লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে তারা। এছাড়া তারা হামাসের বিরুদ্ধে ভূমি থেকে উৎক্ষেপণ করা যায় এমন রকেট লঞ্চারও ব্যবহার করছে বলে জানিয়েছে সামরিক বাহিনী।

আইডিএফ এর মুখপাত্র ড্যানিয়েল হাগারি বলেন, ২০০৬ সালের সংঘাতের পর প্রথমবারের মতো গাজা উপত্যকায় এ ধরনের লঞ্চার ব্যবহার করেছেন তারা। ইসরায়েল দাবি করেছে যে, গাজা উপত্যকায় হামাস বিমান শনাক্ত করতে ব্যবহার করতো এমন একটি স্থাপনা ধ্বংস করা হয়েছে।

দেশটির বিমান বাহিনী এক বার্তায় বলেছে, যুদ্ধ বিমানগুলো গাজার বাইত হানুন এলাকায় ৮০টি স্থাপনায় সারা রাত ধরে হামলা চালিয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে “দুটি ব্যাংকের শাখা অফিস যেগুলো হামাস সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থায়নে ব্যবহার করতো, মাটির নিচে থাকা একটি টানেল এবং ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য ব্যবহৃত দুটি অভিযান পরিচালনা কেন্দ্র।”

এছাড়া প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্রাগার হিসেবে ব্যবহার করা হতো এমন দুটি স্থাপনাতেও হামলা চালানো হয়েছে। আইডিএফ হামাসের সামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে বিমান হামলা অব্যাহত রেখেছে। তাদের দাবি, হামাস অনেক বেসামরিক ভবনেও তাদের সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করেছে।

সিরিয়া থেকে ইসরায়েলে রকেট হামলা চালানো হয়েছিল। তবে এর সাথে কারা জড়িত সে বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না বলে জানিয়েছেন। লেবানন থেকে হেজবুল্লাহও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে যার জবাব ইসরায়েলি বাহিনী দিয়েছে বলেও জানান আইডিএফ এর এই মুখপাত্র। সূত্র : বিবিসি বাংলা

শেয়ার করুন

© All rights reserved © 2017
Developed By

Shipon