আজ শুক্রবার, ১৩ Jun ২০২৫, ০৯:৫৩ পূর্বাহ্ন

Logo
আলোচিত শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন ৮ দিনের রিমান্ডে

আলোচিত শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন ৮ দিনের রিমান্ডে

আলোচিত শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন ৮ দিনের রিমান্ডে

পল্লী জনপদ ডেস্ক ॥

রাজধানীর হাতিরঝিল থানার অস্ত্র আইনের মামলায় শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইনের আট দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। বুধবার (২৮ মে) ঢাকার অতিরিক্ত মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. জাকির হোসাইনের আদালতে শুনানি শেষে এ আদেশ দেন। অন্য তিন আসামির ছয় দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন।

এদিন তাদের আদালতে হাজির করা হয় এবং মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হাতিরঝিল থানার উপপরিদর্শক রিয়াদ আহমেদ তাদের ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন। এ সময় রাষ্ট্রপক্ষ রিমান্ডের পক্ষে শুনানি করেন। অন্যদিকে আসামিপক্ষ রিমান্ড বাতিল ও জামিন চেয়ে আবেদন করেন। উভয় পক্ষের শুনানি শেষে আদালত জামিন নামঞ্জুর করে রিমান্ডের আদেশ দেন।

এর আগে মঙ্গলবার আনুমানিক ভোর ৫টার দিকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি বিশেষ অভিযানে কুষ্টিয়া জেলা থেকে শীর্ষ তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন ওরফে ফতেহ আলী ও তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী মোল্লা মাসুদ ওরফে আবু রাসেল মাসুদকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরবর্তী সময়ে তাদের তথ্যের ভিত্তিতে রাজধানীর হাতিরঝিল এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় সুব্রত বাইনের দুই সহযোগী শ্যুটার আরাফাত ও শরীফকে।

অভিযানের সময় তাদের কাছ থেকে পাঁচটি বিদেশি পিস্তল, ১০টি ম্যাগাজিন, ৫৩টি গুলি এবং একটি স্যাটেলাইট ফোন উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলা করা হয়।

এদিকে, বিকেল ৩টা ৪৭ মিনিটে তাদের আদালতের এজলাসে হাজির করা হয়। এরপর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। তখন কাঠগড়ার রডের সঙ্গে তার হাত হ্যান্ডকাফ দিয়ে বাধা ছিল।

এসময় তিনি বলেন, ‘২০২২ সালের রমজান মাসের ২৬ তারিখ ভারত থেকে আমাকে বাংলাদেশে প্রবেশ করানো হয়। এরপর আমাকে আড়াই বছর আয়নাঘরে রাখা হয়েছে। আয়নাঘরে হাত-পা বেঁধে রাখা হয়েছে। পরে ৫ আগস্ট রাত ৩টার দিকে আমাকে চোখ বেঁধে হাতে হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়।’

তিনি উপস্থিত সাংবাদিকদের উদ্দেশ্য করে বলেন, সাংবাদিকরা যেন তদন্ত করে সত্যিটা লেখেন। আমি যা সেটাই যেন লেখেন। সত্যি কথা লিখবেন। ৮৯ সাল থেকে আমার বিরুদ্ধে লিখছেন। কারও দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কিছু লিখবেন না। বোঝা উচিত কী লিখছেন এবং এর প্রভাব কী হতে পারে। আমার পরিবার আছে। ৬১ বছর বয়স হয়ে গেছে।

তিনি বলেন, এই আধুনিক যুগে যদি আমাকে চাঁদাবাজ বানান? এই আধুনিক যুগে যদি চাঁদাবাজ না ধরতে পারেন, তাহলে কী লাভ। তদন্ত করেন যে, কে আমার নাম ভাঙিয়ে চাঁদাবাজি করলো। আপনারা নতুন প্রজন্মের সাংবাদিক। দোয়া করি আপনাদের জন্য।

পরে এজলাসে বিচারক এলে কথা বলা বন্ধ করেন সুব্রত বাইন।

কে এই সুব্রত বাইন :

সুব্রত বাইনের পুরো নাম ত্রিমাতি সুব্রত বাইন। জন্ম ১৯৬৭ সালে, ঢাকার হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে। বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার জোবারপাড় গ্রামের সন্তান সুব্রত বাইন। মা ও তিন বোনকে নিয়ে মগবাজারে ভাড়া বাসায় বসবাস করতেন। সুব্রত ছিলেন পরিবারের বড় সন্তান।

ছেলেবেলায় পড়াশোনা শুরু বরিশালের অক্সফোর্ড মিশন স্কুলে, পরে ঢাকায় শেরেবাংলা স্কুলে নবম শ্রেণিতে ভর্তি হন সুব্রত। সেখান থেকেই এসএসসি পাস। কলেজে ওঠার পর সুব্রতর অপরাধজগতে প্রবেশ। সিদ্ধেশ্বরী কলেজে ভর্তি হতে গিয়ে এক নেতার সঙ্গে পরিচয় হয় তাঁর, আর সেই সূত্র ধরে অস্ত্র হাতে নেওয়া। পরে মগবাজারে গড়ে তোলেন নিজস্ব সন্ত্রাসী বাহিনী।

তিনি এই বিপণিবিতানের কাছে চাংপাই নামে একটি রেস্টুরেন্টের কর্মচারী ছিলেন। সেখান থেকে ধীরে ধীরে অপরাধজগতের সঙ্গে জড়িয়ে যান। পরে বিশাল সেন্টারই হয়ে ওঠে তার কর্মকা- পরিচালনার কেন্দ্র। এ জন্য অনেকে তাকে ‘বিশালের সুব্রত’ নামেও চেনেন।

একপর্যায়ে চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, দখলবাজিতে অদ্বিতীয় হয়ে ওঠেন সুব্রত বাইন। তখন তিনি থাকতেন নয়াটোলা আমবাগানে। ক্রমে তিনি ওই এলাকায় মূর্তমান এক আতঙ্ক হয়ে ওঠেন।

আধিপত্য বিস্তার করে দরপত্র নিয়ন্ত্রণ ও বিভিন্ন স্থানে চাঁদাবাজিতে তার নাম আসা ছিল তখনকার নিয়মিত ঘটনা। এসব কাজ করতে গিয়ে অসংখ্য খুন-জখমের ঘটনাও ঘটেছে।

নব্বইয়ের দশকে ঢাকার মগবাজারের বিশাল সেন্টার ঘিরে উত্থান হয় শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইনের।

১৯৯৩ সালে রাজধানীর মধুবাজারের এক সবজিবিক্রেতা খুনের ঘটনায় পুলিশের নজরে আসেন সুব্রত বাইন। এরপর মগবাজারের বিশাল সেন্টার নির্মাণের সময় চাঁদাবাজির ঘটনায় তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে। এরপর দ্রুতই হয়ে ওঠেন ভয়ংকর অপরাধী। মগবাজার, রমনা, কারওয়ান বাজার, মধুবাগ- এসব এলাকা ছিল সুব্রত বাইনের দখলে। ১৯৯১ সালে জাসদ ছাত্রলীগ নেতা মুরাদ খুনের ঘটনায় সুব্রত বাইনের যাবজ্জীবন সাজা হয়।

রাজনীতির সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ গড়ে তোলেন সুব্রত। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপির হয়ে মগবাজার এলাকায় কাজ করে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। জন্মদিনের অনুষ্ঠানে বিএনপির শীর্ষ নেতাদের উপস্থিতি সুব্রতকে ‘তারকা সন্ত্রাসীর’ তকমা দেয়। পরে যুবলীগের লিয়াকতের সঙ্গে মগবাজারের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সংঘর্ষে জড়ান।

২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন ৪ দলীয় জোট সরকারের আমলে তাকে ধরিয়ে দিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পুরস্কার ঘোষণা করেছিল। পুরস্কার ঘোষিত ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর অন্যতম এই সুব্রত বাইন। এরপরই সুব্রত বাইন ভারতে পালিয়ে যান। পরবর্তীকালে তিনি সেখানেই গ্রেপ্তার হন।

২০০৩ পর্যন্ত সুব্রত বাইন ছিলেন ঢাকার অপরাধ জগতের প্রভাবশালী চক্র ‘সেভেন স্টার’- গ্রুপের প্রধান।

শীর্ষ এ সন্ত্রাসী আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকার রেড কর্নার নোটিশপ্রাপ্ত।

সুব্রত বাইন কলকাতার কারাগার থেকে ছাড়া পাওয়ার পর পালিয়ে চলে যান নেপালে। সেখানে গিয়ে আবার ধরা পড়ের। এরপর সুড়ঙ্গ করে নেপাল কারাগার থেকে পালিয়ে সুব্রত বাইন আবার কলকাতায় চলে আসেন। সেখানে আবারও ধরা পড়ে। সেই থেকে কলকাতার কারাগারেই ছিলেন।

আওয়ামী লীগ আমলে সুব্রত বাইনকে ফেরত আনতে কূটনৈতিক চ্যানেলে একাধিকবার যোগাযোগ করে সরকার। এরপর দুবছর আগে সুব্রত বাইনকে গোপনে ফেরত পাঠানো হয়।

একাধিক সূত্রে জানা গেছে, প্রায় আড়াই বছর আগে ভারতের জেলখানা থেকে ছাড়া পায় শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন। এরপর ভারতীয় কর্তৃপক্ষ গোপনে পুশব্যাকের মাধ্যমে তাকে বাংলাদেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে তুলে দেয়। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে এ হস্তান্তর প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়।

কিন্তু তাকে আদালত না পাঠিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সরাসরি গোপন বন্দিশালায় নিয়ে যায়।

একটি সূত্র জানায়, ৫ আগস্টের পর গোপন বন্দিশালা থেকে সুব্রত বাইন ছাড়া পেয়ে ফের চাঁদাবাজি শুরু করেন। মগবাজারের বিশাল সেন্টার ঘিরে আবারও গড়ে তোলেন বিশাল বাহিনী।

জানা যায়, ২৯ সেপ্টেম্বর হঠাৎই বিশাল সেন্টারে যান সুব্রত বাইন। তবে সেখানকার পুরোনো ব্যবসায়ীরা তাকে প্রথমে চিনতে পারেননি। মুখে দাড়ি রেখেছেন, চেহারায়ও বেশ পরিবর্তন এসেছে। তখন মুরাদ নামের এক ব্যক্তি তাকে সুব্রত বাইন বলে পরিচয় করিয়ে দেন। একটি দোকান দখলের ঘটনাকে কেন্দ্র করে তিনি সেখানে গিয়েছিলেন বলে জানা যায়।

হঠাৎ সুব্রত বাইনের আগমনের খবরে বিশাল সেন্টারের ব্যবসায়ীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। কারণ, এই মার্কেট থেকে সুব্রতকে একসময় প্রতি বর্গফুটে দুই টাকা করে দিতে হতো। তবে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের টানা তিন মেয়াদের মাঝামাঝি সময়ে এসে ওই টাকা দেওয়া ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায়। সুব্রত বাইনের আগমনের পর নতুন করে আবার চাঁদা দিতে হতে পারে—ব্যবসায়ীদের মধ্যে এমন আশঙ্কা তৈরি হয়।

আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী মতিঝিলের ইখতিয়ারের [মালিবাগ সানরাইজ হোটেলে ডিবি পুলিশ হত্যা মামলার আসামি] মাধ্যমে বেশ কিছু অত্যাধুনিক অস্ত্র কিনেছেন সুব্রত বাইন।

বর্তমানে থানা থেকে লুট হওয়া প্রায় ১৭টি অস্ত্র রয়েছে তার হাতে। সুব্রত বাইনের ডান হাতখ্যাত পুরস্কার ঘোষিত আরেক সন্ত্রাসী মোল্লা মাসুদের মাধ্যমে মতিঝিল গোপীবাগের একটি ক্রীড়া প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিলেন সুব্রত।

এছাড়া, সুব্রত বাইন সুইডেন আসলামের সঙ্গে দেখা করে কাওরান বাজার একসঙ্গে নিয়ন্ত্রণ করার ব্যাপারেও সমঝোতা করেছেন। এরপর থেকে তাকে ধরতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর শুরু করেন।

সুব্রত বাইনের নামে ৩০টিরও বেশি খুনের মামলা রয়েছে, যার প্রায় সবগুলোতেই সাজাপ্রাপ্ত তিনি। এছাড়া অবৈধ অস্ত্র এবং চাঁদাবাজিসহ প্রায় ১০০ মামলার আসামি তিনি। ২০০৩ পর্যন্ত সুব্রত বাইন ছিলেন ঢাকার অপরাধ জগতের প্রভাবশালী চক্র ‘সেভেন স্টার’- গ্রুপের প্রধান। শীর্ষ এ সন্ত্রাসী আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকার রেড কর্নার নোটিশপ্রাপ্ত।

শেয়ার করুন

© All rights reserved © 2017
Developed By

Shipon