আজ শুক্রবার, ১৩ Jun ২০২৫, ১০:১৫ পূর্বাহ্ন
পল্লী জনপদ ডেস্ক ॥
প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা, পরিকল্পিত উদ্যোগের অভাব, বাঁশের চাষাবাদ ও বাঁশ-বেত সামগ্রীর চাহিদা কমায় হারাতে বসেছে পটুয়াখালীর বাউফলের ঐতিহ্যবাহী বাঁশ-বেত শিল্প। ফলে এ পেশার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট উপজেলার কয়েকশ’ পরিবার চলছে আর্থিক টানাপোড়েনে। অনেকে বংশ পরম্পরায় করে আসা এ পেশা ছেড়ে যাচ্ছেন ভিন্ন পেশায়।
বর্তমান বাজারে প্লাস্টিক পণ্য সামগ্রীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে টিকে থাকতে না পেরে মুখ থুবড়ে পড়েছে এককালের ঐতিহ্যবাহী এই শিল্প। অপরদিকে, উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় অভাব-অনটনের মধ্যদিয়ে দিনাতিপাত করছেন বাঁশ শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলো। পরিবার-পরিজন নিয়ে বেঁচে থাকতে তারা এ পেশাকে ছেড়ে অন্য পেশায় ঢুকে পড়ছেন। ঐতিহ্যবাহী শিল্পকর্মটি দেশ থেকে বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
জানা গেছে, বাউফলের দাসপাড়া, বগা, নওমালা, কাছিপাড়া ও মদনপুরা ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামে বিগত কয়েক দশক ধরে প্রায় দুই শতাধিক পরিবার বাঁশ শিল্পের সাথে সম্পৃক্ত ছিল। একসময় বাউফলে গৃহস্থ পর্যায়ে প্রচুর বাঁশ উৎপাদিত হতো।
অপরদিকে, বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জে ১৪টি ইউনিয়নে একসময় মাঠে চাষ হতো বেত গাছ। বাড়ি ভিটেতে দেখা যেত বাঁশের বাগান। এ ছাড়াও যত্রতত্রভাবে বাড়ির আঙ্গিনা ভিটে মাঠে হামেশাই চোখে পড়তো বেতগাছ। আর সে সময়গুলোতে গ্রামীণ জনপদের মানুষ গৃহস্থালি, কৃষি ও ব্যবসা ক্ষেত্রে বেত ও বাঁশের তৈরি সরঞ্জামাদি ব্যবহার করতেন। বাসা-বাড়ি, অফিস-আদালত প্রায় সবখানেই চোখে পড়তো বেতের তৈরী আসবাবপত্র। এখন সময়ের বিবর্তনে বদলে গেছে এসব চিরচেনা চিত্র। বর্তমান সময়ে বেত শিল্প প্রায় বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে।
এক সময় উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে শত শত পরিবার এই বাঁশ বেতের তৈরি পণ্য বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করত। এখন তারা অন্য পেশায় চলে গেছেন। উপজেলার পাদ্রীশিবপুর ইউনিয়নের কানকি বাজার সংলগ্ন শ্রীমন্ত নদীর পাশে দেখা যায় প্রায় ১০টি পরিবারে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও এই কাজ করছেন। ছোট ছোট ছেলে মেয়েরাও বাঁশ আর বেত দিয়ে বিভিন্ন রকম পণ্য তৈরি করছে।
এসব গ্রামের মানুষের প্রধান পেশা বাঁশ-বেত শিল্প নির্ভর হওয়ায় আশপাশে দ্রুত এ শিল্পের নামে পরিচিতি লাভ করে পুরো এলাকা। এখানকার বাঁশ-বেত শিল্পীরা তাদের সুনিপুণ হাতের কারুকাজে তৈরি করতো শৌখিন ও নিত্যপ্রয়োজনীয় হরেক সামগ্রী।
তাদের তৈরি সামগ্রীর মধ্যে ছিল- বিছানার পাটি, চাটাই, ডোল, জাবার, হাতপাখা, ডুলা, খলই, ওড়া, পইছা, ঝুঁড়ি, চালনা, কুলা, মুড়া, চাই ইত্যাদি নানা বাহারি জিনিস।
পরিবারের ছেলে, বুড়ো, নারী, শিশু সবাই মিলে করতেন এ কাজ।
এ ছাড়া চট্টগ্রাম থেকেও বাউফলসহ দক্ষিণাঞ্চলে প্রচুর বাঁশ আনা হতো। ওই বাঁশ দিয়ে চালুন, কুলা, সাঝি, ধান-চাল ও ডাল সংরক্ষণের জন্য মোড়া, বাজার করার খাড়ই (টোনা), মাটি কাটার বিড়া, চাল মাপার পুরা, মাছ ধরার পল্লা, চাষাবাদের জন্য চঙা, চাল ধোয়ার ঝাঁঝড়ি, ঝুড়ি, ঠাকনা ও সৌখিন অনেক পণ্যসহ গৃহস্থালী কাজের অনেক জিনিস তৈরি করা হতো। এগুলো প্রত্যেক পরিবারের জন্যই ছিল অপরিহার্য্য। কিন্তু কালের বিবর্তনে বাজারে প্লাস্টিকের হরেক রকমের পণ্য আসায় হারিয়ে যাচ্ছে এ শিল্পটি।
একদিকে যেমন এলাকায় বাঁশ উৎপাদন নেই, তেমনি চট্টগ্রাম থেকেও কোনো বাঁশ এ অঞ্চলে আসছে না। অপরদিকে, প্লাস্টিকের বাজারে প্রতিযোগিতায় বাঁশের পণ্যগুলো টিকতেও পারছে না। ফলে এ শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলোতে নেমে এসেছে দুর্দিন। বেঁচে থাকার তাগিদে অনেকেই পেশা বদল কলছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে বাউফলে হাতেগোনা ১৫ থেকে ১৬টি পরিবার এ শিল্পের সাথে কোনো রকমে টিকে রয়েছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, পুরুষদের পাশাপাশি বাঁশ শিল্পের সাথে তিন শতাধিক নারী জড়িত ছিলেন।
এছাড়া পরিবারের মেয়ে সন্তানরাও এ কাজে সহায়তা করত। বাঁশের কাজ করে নারীরা স্বাবলম্বী ছিলেন এবং তাদের কাছে জমাকৃত টাকা মেয়ের বিয়ে কিংবা স্বামী-সংসারের প্রয়োজনীয় অন্য কাজে লাগাতেন। এখন কাজ না থাকায় ওই নারী শিল্পীরা বেকার হয়ে পড়েছেন। বাঁশ শিল্পের সাথে জড়িত অঞ্জনা নামের এক গৃহবধূ জানান, বাঁশের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, চাহিদা কম, পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি এবং পণ্য বিক্রি করতে গিয়ে বাজারে অতিরিক্ত খাজনা দিতে বাধ্য হওয়ায় এখন আর লাভ হয় না। ফলে তাদের সংসারে অভাব-অনটন লেগেই আছে। অনিমা, মায়া রানী ও অর্চনা রাণী নামের বাঁশ শিল্পীরা জানান, কাজ না থাকায় তাদের হাতে কোনো টাকা পয়সা থাকে না। ফলে নিজের রুচি কিংবা চাহিদা মোতাবেক কোনো জিনিষপত্রও কিনতে পারছেন না।
যে কোনো প্রয়োজনে স্বামী বা সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে থাকতে হয়। তাদের অভিমত, বাঁশ শিল্পকে রক্ষা করতে হলে বাজারে বাঁশপণ্যের খাজনাবিহীন বিক্রির সুযোগ করে দিতে হবে। করতে হবে সরকারিভাবে পৃষ্ঠপোষকতা। সরকারিভাবে প্লাস্টিক ব্যবহারের খারাপ দিকগুলো প্রচার করতে হবে। সচেতনমহল মনে করেন, এ শিল্পটি ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পের অন্তর্ভুক্ত হলেও সরকারি কিংবা বেসরকারি কোনো সংস্থাই এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখার ভূমিকা নিচ্ছে না।
বাঁশ শিল্পকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে হলে জরুরি ভিত্তিতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা, পরিকল্পনা ও আধুনিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা দরকার। সে সঙ্গে পেশায় জড়িতদের তালিকা করে সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করা উচিত।
এমন পরিস্থিতিতে বাঁশ-বেতের জিনিপত্রের চাহিদা কমে যাওয়ায় একদিকে যেমন সংকটে পড়েছেন কারিগররা। অপরদিকে মানুষ হারাতে বসেছে গ্রামীণ এই প্রাচীন ঐতিহ্য। এভাবে প্রাচীন ঐতিহ্যগুলো হারিয়ে গেলে আগামী প্রজন্ম এগুলোর সম্পর্কে জানতে পারবে না। তাই কৃষি দপ্তরের এখন উদ্যোগ নেয়ার দরকার যাহাতে পর্যাপ্ত পরিমাণে বাঁশ-বেতের উৎপাদন বাড়ানো যায়। পাশাপাশি কৃষকদের পরামর্শ দিয়ে বাঁশ ও বেত চাষের আগ্রহী করে তোলা। না হয় সেই দিন আর বেশি বাকি নেই প্রাচীন এই ঐতিহ্য কুটির শিল্প হারিয়ে যেতে।