আজ রবিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৫, ০৯:৪৩ পূর্বাহ্ন
পল্লী জনপদ ডেস্ক ॥
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নামমাত্র শুধু সরকারি নিয়ম অনুযায়ী ১০ টাকা দিয়ে টিকিট কেটে চিকিৎসা পাওয়ার আশায় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিশেষ করে হতদরিদ্র, নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তরা রোগী নিয়ে আসেন। বর্তমানে নতুন দালাল গ্রুপ ২৪ ঘণ্টা হাসপাতালে উপস্থিত থেকে এ অসহায় রোগীদের নিয়ে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।
এ দালাল চক্রদের রোগী ভাগিয়ে নেওয়ার কার্যক্রম প্রকাশ্যে চলে আসে গত বুধবার ( ২৪ সেপ্টেম্বর) দিবাগত রাতে হাসপাতালের জরুরি বিভাগ চত্বরে ও চতুর্থ শ্রেণির কল্যাণ সমিতির প্রবেশের দুয়ারে দুই গ্রুপের কয়েক দফা সংঘর্ষের ঘটনায় ।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকা মেডিকেলের মতো একটি ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানে এমন নৈরাজ্য সত্যিই উদ্বেগজনক। হাসপাতালের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা সূত্র থেকে রোগী ভাগিয়ে নেওয়ার এসব তথ্য জানা গেলেও স্বয়ং হাসপাতাল পুলিশই বলছে, ঢামেক থেকে রোগী ভাগিয়ে বেসরকারি হাসপাতালে নেওয়ার কেন্দ্র করে দুই দালাল গ্রুপের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।
বৃহস্পতিবার (২৫ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় আবার একই ঘটনা পুনরায় ঘটার সম্ভাবনার সংবাদে জরুরি বিভাগ চত্বরে উপস্থিত হন হাসপাতাল পরিচালক। গতকাল বুধবার হাসপাতালে দালাল গ্রুপের আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের ঘটনায় আজ সন্ধ্যায় জরুরি বিভাগে প্রায় ১০ থেকে ১৫ বাইক নিয়ে সন্ত্রাসীদের কায়দায় একটি গ্রুপকে মহড়া দিতে দেখা যায়। এমন মহড়ার সংবাদে উপস্থিত হন পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান।
তিনি জরুরি বিভাগ চত্বরে উপস্থিত দায়িত্বরত আনসারদের উদ্দেশে বলেন, হাসপাতালে সন্ত্রাসীদের মতো বাইক নিয়ে মহড়া দিলো অথচ আপনারা কাউকে ধরলেন না কেন? আপনাদের ভয়ের কিছু নেই আমরা আছি, প্রশাসনের কোনো ভয় থাকার কথা না। এছাড়া তিনি বলেন, গতকালকে হাসপাতালে দালাল দুই গ্রুপের সংঘর্ষের ঘটনার লেখালেখি হয়েছে। এ ঘটনার মানে কি? হাসপাতালে কোনো কর্তৃপক্ষ নেই? রোগীদের চিকিৎসায় ব্যাঘাত ঘটানোর চেষ্টা করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ সময় হাসপাতালে চত্বরে পার্কিংয়ে থাকা সব বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সকে হাসপাতাল থেকে বের করে দেওয়ার পাশাপাশি হাসপাতালে বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সদের অফিস বন্ধেরও নির্দেশ দেন।
এ সময় হাসপাতাল পরিচালকের জিজ্ঞাসার কারণে বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স নেতা বাদল বলেন, বাইরের শাহাদাত নামে এক ব্যক্তি তার দলবল নিয়ে হাসপাতাল থেকে প্রায় সময় রোগী ভাগিয়ে অন্য হাসপাতালে নিয়ে যায়। পাশাপাশি তারা হাসপাতালে রাতের বেলায় এসে বিশৃঙ্খলা করে। এটাই আমাদের লোকজন বাধা দেওয়ার কারণে আমাদের ওপর তারা হামলা করে কয়েকজনকে কুপিয়ে আহত করে। এ কথার পরিপ্রেক্ষিতে পরিচালক বাদলকে লক্ষ্য করে বলেন, তাহলে কি আপনাদের কোনো দোষ নেই? আপনারা সাধু?
এদিকে দালালদের দুই গ্রুপের সংঘর্ষের ঘটনায় হাসপাতালের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা বলছে, ঢাকা মেডিকেল হাসপাতাল বর্তমানে চলছে রাজনৈতিক তকমা লাগিয়ে ফ্যাসিবাদের ভয় দেখিয়ে কোণঠাসা করার পাশাপাশি গণঅভ্যুত্থানের পরে যারা হাসপাতালের সরকারি-বেসরকারি কোনো কর্মচারী না হয়েও দালালি করার জন্য নিজেরাই একটি দলের রাজনৈতিক তকমা দিয়ে নেতা পরিচয় প্রভাব বিস্তার করছে। তাদের একটাই লক্ষ্য হাসপাতালের আগত রোগীদের অন্য হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে বাণিজ্য করা।
সূত্র থেকে আরও জানা যায়, গতকাল রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চত্বরে রোগী ভাগিয়ে অন্য হাসপাতালে নেওয়ার কেন্দ্র করে দালালদের দুই গ্রুপের মারামারির ঘটনা ঘটে। এ সময় স্বাভাবিকভাবেই হাসপাতালে রোগীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। শাহাদাত (তিনি নিজেকে একটি দলের ছাত্রনেতা হিসেবে পরিচয় দেয়) নামের এক যুবক রোগী ভাগিয়ে নেওয়ার শক্তি প্রয়োগের কারণে হাসপাতালে বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স নেতারা, মালিক ও কর্মচারীদের মধ্যে মারামারি ঘটে।
গোয়েন্দা সূত্রে এটিও জানা যায়, হাসপাতাল চত্বরে রাত দিন ২৪ ঘণ্টা অবস্থানরত অ্যাম্বুলেন্স চালক, তাদের নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মচারীরা রোগী ভাগিয়ে নেওয়ার এই দালালি কাজে সরাসরি যুক্ত। এসব কারণেই রোগী ভাগিয়ে নেওয়ার আধিপত্যকে জানান দেওয়ার জন্যই দালালদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। একপর্যায়ে শাহাদাত গ্রুপের হামলায় হাসপাতালে বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সের মালিকসহ এরকম দুই একজন আহত হয়। এদের মধ্যে ইমন নামে একজন অ্যাম্বুলেন্স মালিক আছেন। তবে ইমনের ওপরে দ্বিতীয় দফা হামলা করা হয় সমিতি অফিসের সামনে।
বাংলাদেশ চতুর্থ শ্রেণির সরকারি কর্মচারী সমিতির ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল শাখার ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মো. আজিম বলেন, আমাদের সমিতির অফিসের ভেতরে কোনো মারামারির ঘটনা ঘটেনি তবে অ্যাম্বুলেন্স মালিক ইমন নামে একটি ছেলে আমাদের অফিসের সামনে বসেছিল। এ সময় বাইরের কিছু বহিরাগত লোকজন তার ওপরে হামলা করে।
তিনি আরও বলেন, ঘটনাটি বুধবার দিবাগত রাত ১২টায়, সেই সময় তিনি অফিসে উপস্থিত ছিলেন না। পরে বিস্তারিত জানতে পেরেছেন। তবে আমাদের অফিসে বাইরের লোকজনদের হট্টগোল আতঙ্ক সৃষ্টি এ ব্যাপারে আমরা আইনি পদক্ষেপের সিদ্ধান্ত আলোচনা সাপেক্ষে নেওয়া হবে।
এদিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পুলিশ ক্যাম্প ইনচার্জ (ইন্সপেক্টর) মো. ফারুক বলেন, গতকাল রাতে হাসপাতালে চত্বরে দুই গ্রুপ দালালদের একটি মারামারির ঘটনা ঘটে। পরে পুলিশ উপস্থিত হয়ে তাদের হাসপাতাল থেকে বিতাড়িত করে। একপর্যায়ে হাসপাতালের বাইরে বাউন্ডারি সীমানা সংলগ্ন সমিতির অফিসের সামনেও বলে মারামারির ঘটনা ঘটেছে। বিষয়গুলো আমরা তৎক্ষণিক শাহবাগ থানাকে অবগত করি। তবে যতটুক জানা গেছে, হাসপাতাল থেকে বাইরের বেসরকারি হাসপাতালে রোগী ভাগিয়ে নেওয়ার আধিপত্য বিস্তার কেন্দ্র করে দালালদের মধ্যে এ মারামারির ঘটনা ঘটে। এদের মধ্যে একটি দলের রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের সাবেক নেতা পরিচয়দানকারী শাহাদাত ও হাসপাতালের বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স মালিক ইমনসহ আরো কয়েকজনের সঙ্গে এ মারামারির ঘটনা ঘটে।
ফ্যাসিবাদ আমলের শেষের পাঁচ বছর ঢামেক হাসপাতালের পুলিশ ক্যাম্পে দায়িত্বে থাকায় (বর্তমানে অবসরে) এক পুলিশ সদস্য জানান, সেই সময় ফ্যাসিবাদ লোকজন বেসরকারি হাসপাতালে অর্থের বিনিময়ে রোগী ভাগিয়ে নিয়ে যেত। তিনি একথাও বলেন, বেসরকারি হাসপাতাল থেকে রোগী প্রতি দালালরা ৩০০০ টাকা করে প্রতিদিন বিল পেতো বলে আমরা এরকম সংবাদ পেয়েছিলাম মানে সরাসরি ক্ষমতা দেখিয়ে রোগী নিয়ে ব্যবসা । এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখন শুনেছি সেই ফ্যাসিবাদের লোকজন কেউ নেই নতুন করে দালাল সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে কিন্তু বর্তমান দালালদেরও কাজ সেই একই।
এদিকে শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খালিদ মুনসুর বলেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারামারির ঘটনায় আহতদের পক্ষ থেকে থানায় একটি অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। সেই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে নাম উল্লেখ করে মামলা হয়েছে।
এছাড়া তিনি জানান, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যারা মারামারি করেছে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে, তারা হাসপাতালে সরকারই বা বেসরকারি কর্মচারী নয়, তবে তারা কারা বিষয়গুলো তদন্ত করে দেখা হচ্ছে হতে পারে দালাল? তবে যেহেতু মারামারির ঘটনায় আহত হয়েছে রক্তাক্ত হয়েছে ওই আহত ব্যক্তি থানায় এসে আইনগত ভাবে বিচার পাওয়ার অধিকার তার আছে, এর পরিপ্রেক্ষিতে মামলা হয়েছে। তবে সবকিছু বিষয়ই তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজে হাসপাতালে দালাল চক্র ও চিকিৎসা ব্যবস্থার নৈরাজ্য নিয়ে তীব্র উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডক্টর তৌহিদুল হক।
তিনি বলেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রোগী ভাগাভাগি নিয়ে দালাল চক্রের সংঘর্ষ ও সহিংসতা এবং এসব ঘটনায় হাসপাতালের কিছু কর্মচারীর সম্পৃক্ততার অভিযোগ আমাদের বারবার হতাশ করে। দেশের সবচেয়ে বড় সরকারি হাসপাতালটিতে দালালদের আধিপত্য এবং তা ঘিরে সংঘর্ষ কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়,এটি একটি নিয়মিত চিত্রে পরিণত হয়েছে। আমাদের মনে রাখতে হবে, স্বাস্থ্যসেবা কোনো পণ্য নয়, এটি একটি মানবিক অধিকার। যদি রোগী হয়রানির শিকার হয়ে চিকিৎসার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন, কিংবা চিকিৎসা বিলম্বিত হয়, তাহলে এর দায় কে নেবে? এই প্রশ্নের উত্তর রাষ্ট্র ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে দিতে হবে। এ অবস্থা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে, যা প্রমাণ করে, সমস্যার সমাধানের প্রতি প্রকৃত কোনো সদিচ্ছা নেই। পরিবর্তন চাইলে, সবার আগে এই অনৈতিক চক্র ভেঙে দিতে হবে। না হলে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ইতিহাস ও অর্জনের জায়গায় বড় ধরনের হোঁচট খাওয়ার আশঙ্কা থেকেই যাবে।
সূত্র : বাংলানিউজ