আজ শুক্রবার, ১৩ Jun ২০২৫, ১০:৪৯ পূর্বাহ্ন
পল্লী জনপদ ডেস্ক ॥
পবিত্র রমজান মাসের সবচেয়ে পুণ্যময় একটি রজনীর নাম হচ্ছে লাইলাতুল কদর, যা ‘শবে কদর’ নামে পরিচিত। এই রজনীর বরকত ও পুণ্য সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের পূর্ণ একটি সূরা অবতীর্ণ হয়েছে। এই রাতের ফজিলত পবিত্র কুরআনুল কারীমে বর্ণিত হয়েছে, ‘কদরের এরাতটি এক হাজার মাসের (ইবাদতের) চেয়ে উত্তম। ‘ এক হাজার মাসে তিরাশি বছর চার মাস হয়ে থাকে। ওই ব্যক্তি ভাগ্যবান, যে এই রাতটি ইবাদত বন্দেগীর মধ্যে কাটিয়ে দিতে পারে। কেননা, এর মাধ্যমে সে তিরাশি বছর চার মাসের চেয়েও বেশি সময় ইবাদতে লিপ্ত থাকার সৌভাগ্য অর্জন করে। আর অধিক সময়ের সীমা কী তা একমাত্র আল্লাহ তাআলা ছাড়া আর কেউ বলতে পারে না। কুরআনে পাকে হাজার মাসের অধিক বলার কারণ হল, তখনকার আরবদের মধ্যে গণনার ক্ষেত্রে হাজারকেই সবচেয়ে বড় সংখ্যা গণ্য করা হত। অতএব, কুরআনের উদ্দেশ্য এখানে হাজার মাসে সীমাবদ্ধ করা নয়; বরং অধিক বুঝানোই উদ্দেশ্য। নিম্নে পবিত্র কুরআনে এই পুণ্যময় রজনী সম্পর্কে যে ঘোষণা এসেছে, তার সারমর্ম তুলে ধরা হল।
নিশ্চয় আমি কুরআন শরীফ কদরের রাতে অবতীর্ণ করেছি। (সূরা কদর : ১)। এই আয়াতের মর্ম হল: কুরআন শরীফ লওহে মাহফুয হতে দুনিয়ার আকাশে এ রাতে অবতীর্ণ করা হয়েছে। এই একটি মাত্র বিষয়ই এ রাতের ফযীলতের জন্য যথেষ্ট ছিল যে, আল-কুরআনের মতো মর্যাদাবান ঐশীগ্রন্হ এ রাতে অবতীর্ণ হয়েছে, এই রাতের মর্যাদা ও মাহাত্ম্যের জন্য অন্য কোনো ফযীলত ও বরকতের প্রয়োজন ছিল না। তদুপরি পরবর্তী আয়াতে আগ্রহ বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে ইরশাদ হচ্ছে : আপনি কি অবগত আছেন যে, কদরের রাত কত মর্যাদা সম্পন্ন রাত? (সূরা কদর : ২)। অর্থাৎ এ রাতের মাহাত্ম্য ও ফযীলত সম্পর্কে আপনি কি অবগত রয়েছেন যে, এ রাতের কতটুকু কল্যাণ ও কী পরিমাণ ফযীলত রয়েছে? অত:পর এ রাতের ফযীলতের বিবরণ আলোচিত হয়েছে : শবে কদর হল হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। (সূরা কদর : ৩)। এর সারমর্ম হল, হাজার মাস ইবাদত করলে যে পরিমাণ সাওয়াব হয়, কদরের রাতে ইবাদত করার সাওয়াব এর চেয়েও বেশি। আর এ বেশি হওয়ার কোনো সীমারেখা নেই যে, কি পরিমাণ বেশি সাওয়াব হবে। ‘এতে প্রত্যেক কাজের জন্যে ফেরেশতাগণ ও রুহ অবতীর্ণ হয় তাদের পালনকর্তার নির্দেশক্রমে।’ (সূরা কদর : ৪)।
আল্লামা রাযী (রহ.) লিখেছেন যে, ফেরেশতাগণ যখন প্রথমাবস্থায় পৃথিবীতে আল্লাহর খলীফা হিসেবে মানুষ সৃষ্টির সম্পর্কে অবগত হয়েছিলেন, তখন মানুষের প্রতি তাচ্ছিল্য প্রকাশ করে আল্লাহ তাআলার দরবারে আরজ করেছিলেন যে, আপনি এমন এক সম্প্রদায় সৃষ্টি করতে যাচ্ছেন, যারা দুনিয়ায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে এবং রক্ত প্রবাহিত করবে। এমতাবস্থায় শবে কদরে আল্লাহর পক্ষ হতে তাওফীকপ্রাপ্ত হয়ে যখন মানুষ আল্লাহ তাআলার পরিচিতি লাভ ও আনুগত্যকরণে লিপ্ত হয়, তখন ফেরেশতাগণ তাদের অজ্ঞতার ওযর পেশ করার জন্য অবতীর্ণ হন। এ রাতে ‘রুহুল কুদুস’ তথা হযরত জিবরাঈল (আ.)-ও অবতরণ করেন। এ প্রসঙ্গে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন যে, শবে কদরে হযরত জিবরাঈল (আ.) একদল ফেরেশতাসহ অবতরণ করেন এবং যে ব্যক্তিকে যিকির ও অন্যান্য ইবাদতে লিপ্ত দেখেন, তার জন্য রহমতের দুআ করে থাকেন। ‘তাঁদের রবের নির্দেশে প্রত্যেক কল্যাণকর বিষয়সহ (পৃথিবীর দিকে অবতরণ করেন)। হাদীসের ব্যাখ্যাগ্রন্থ মাযাহিরে হকের মধ্যে উল্লেখ আছে যে, এ রাতে ফেরেশতাদের জন্ম হয়েছে। এ রাতে হযরত আদম (আ.) কে সৃষ্টি করার উপকরণ একত্রিত করা আরম্ভ হয়েছে। এ রাতে জান্নাতে গাছ সৃষ্টি হয়েছে এবং এ রাতে দুআ ও অন্যান্য ইবাদত কবূল হওয়ার বিবরণও অনেক বর্ণনায় বিদ্যমান রয়েছে। একটি বর্ণনায় রয়েছে যে, এ রাতে হযরত ঈসা (আ.) কে আসমানে ওঠিয়ে নেয়া হয়েছে এবং এ রাতে বনী ইসরাঈলের তওবা কবূল করা হয়েছে। ‘এ রাত সালাম তথা নিরাপত্তার রাত, যা ফজর পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।’ (সূরা কদর : ৫)।
প্রথম সংশয় : কুরআনে কারীমে শবে কদরকে হাজার মাস থেকে উত্তম আখ্যা দেয়া হয়েছে। এখানে সংশয় হল প্রতি বছরই তো একটি শবে কদরের আগমন ঘটবে, অর্থাৎ, সাওয়াবের জন্য পদত্ত হাজার মাস তথা তিরাশি বৎসরের মধ্যেও তো তিরাশিটি শবে কদর রয়েছে। এক্ষেত্রে হিসাব কীভাবে করবে? তাফসীরে মাআরিফুল কুরআনে এ সংশয়ের নিরসনে বলা হয়েছে যে, এই হিসাব থেকে শবে কদর বাদ দিতে হবে। আর শবে কদরকে বাদ দিয়ে হিসাব করলে হিসাবের সমস্যা নিরসন হয়ে যায়। দ্বিতীয় সংশয় : অনেকের মধ্যেই একটি সংশয় হল যে, সারাবিশ্বেই কি শবে কদর একই সময় হয়ে থাকে ? ফেকাহবিদগণ বলেছেন যে, শবে কদরের বিষয়টি মূলত: চাঁদের সঙ্গে সম্পৃক্ত। যে দেশে যেদিন চাঁদ উদিত হবে, সেই দেশে সেখানকার চাঁদ উদয়ের তারিখ হিসাব করে শবে কদর সাব্যস্ত করতে হবে। তৃতীয় সংশয় : অনেকেই মনে করে থাকেন, যে রাতে শবে কদর হবে, সে রাতের পুরোটাই ইবাদত বন্দেগীতে কাটাতে সক্ষম হলেই হাজার মাসের সাওয়াব অর্জিত হবে, অন্যথায় নয়। এ প্রসঙ্গে হাদীসের বিশুদ্ধ কিতাব মুসলিম শরীফে হযরত ওসমান (রা.) মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন। যাতে বলা হয়েছে: ‘যে ব্যক্তি ইশার নামাজ জামাআতের সঙ্গে আদায় করল, সে অর্ধরাত নফল ইবাদতের সাওয়াব পেল। আর সেই ব্যক্তি যখন ফজরের নামাযও জামাআতের সঙ্গে আদায় করল, সে সম্পূর্ণ রাত জেগে থেকে ইবাদত করার সাওয়াব অর্জন করল।’ [মাআরিফুল কুরআন: খন্ড-৮, পৃষ্ঠা-৭৯৩]
‘শব’ ফার্সি শব্দ। আরবীতে ‘লাইলাতুন’ এর প্রতিশব্দ। অর্থাৎ লাইলাতুল ‘বরাত’ এবং ‘লাইলাতুল কদর’। ‘শব’ বা ‘লাইলাতুন’ শব্দের অর্থ ‘রাত’। আর ‘বরাত’ শব্দের অর্থ হল: ‘ক্ষমা লাভ করা’ বা ‘নাজাতপ্রাপ্ত হওয়া’। এ হিসাবে ‘লাইলাতুল বরাত’ বা ‘শবে বরাতে’র অর্থ হল: ‘ক্ষমা লাভ করার রাত’ বা ‘নাজাত প্রাপ্তির রাত’। আর ‘লাইলাতুল বরাতের’ দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে অর্ধ শাবানের রাত (শাবানের ১৫ তারিখের রাত)। এ রাতেও মানবজাতির এক বছরের জাগতিক সব বিষয় ফায়সালা করা হয়। আর ‘কদর’ শব্দের অর্থ হল: ‘সম্মান ও মর্যাদা’। এ হিসাবে ‘লাইলাতুল কদর’ -এর অর্থ দাঁড়ায়- ‘সম্মান ও মর্যাদা অর্জনের রাত’। হযরত আবু বকর ওয়ারাকাহ (রহ.) বলেন: এ রাতকে এজন্য ‘লাইলাতুল কদর’ বলাহয় যে, ইতিপূর্বে আমলহীনতার কারণে যে ব্যক্তির কোনো কদর ও সম্মান-মর্যাদা ছিল না, এ রাতের তওবা, ইস্তিগফার ও ইবাদত বন্দেগীর মাধ্যমে সে ব্যক্তি মর্যাদাবান ও সম্মানিত হয়ে যায়। কদরের আরেকটি অর্থ হচ্ছে ‘তাকদীর’। এ অর্থ হিসেবে ‘লাইলাতুল কদর’ নামকরণের কারণ হচ্ছে, তাকদীরের যে অংশ এ বছর রমজান হতে পরবর্তী রমজান পর্যন্ত বাস্তবায়িত ও সংঘটিত হবে তা ওইসব ফেরেশতাদের কাছে সোপর্দ করা হয়, যারা জাগতিক বিষয়াদি বাস্তবায়নের দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছেন।
এ সম্পর্কে হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, এক হাদীসে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘তোমরা শবে কদরকে রমজান মাসের শেষ দশকের বেজোড় রাতসমূহে অনুসন্ধান কর।’ এ হিসাব অনুযায়ী শবে কদর ২১,২৩,২৫,২৭ ও ২৯ রমজানের রাত সমূহে অনুসন্ধান করা উচিত।’ হযরত আবু যর গিফারী (রা.) হতে বর্ণিত আছে তিনি বলেন: আমি হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আরয করলাম, ‘শবে কদর নবী-যুগের সাথে নির্দিষ্ট না পরেও হবে?’ উত্তরে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করলেন: ‘এটি কিয়ামত পর্যন্ত অবশিষ্ট থাকবে।’ আমি আরয করলাম: ‘এটি রমজানের কোন অংশে হয়ে থাকে?’ তিনি বললেন, ‘প্রথম দশদিন ও শেষ দশদিনে অনুসন্ধান কর।’ অত:পর হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্যান্য কথাবার্তায় নিমগ্ন হলে আবার সুযোগ পেয়ে আমি আরয করলাম: ‘এটি বলে দিন যে, দশদিনের কোন অংশে হয়ে থাকে?’ এটি শুনে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এত বেশি অসন্তুষ্ট হলেন যে, তিনি ইতিপূর্বে ও পরে আমার উপর কখনও এরুপ রাগান্বিত হন নি। এমতাবস্থায় বললেন: ‘এরুপ উদ্দেশ্য হলে আল্লাহ তাআলা কি বলে দিতে পারতেন না ? শেষ দশকের রাতসমূহে এটি অনুসন্ধান কর। এটিই যথেষ্ট এরপর আর কোনোকিছু এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা কর না।’
১২ মাসের মধ্যে সবচেয়ে ফজিলতপূর্ণ মাস হচ্ছে রমজান। আর রমজানের শেষ দশক আরো মর্যাদাপূর্ণ। মহান আল্লাহ তায়ালা বান্দার প্রতি বিশেষ দয়া করে লাইলাতুল কদর দিয়েছেন। হাদিসে এসেছে, যে ব্যক্তি কদরের রাতে ঈমান অবস্থায় সাওয়াবের আশায় ইবাদত করে তার আগের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়। কদর পাওয়ার সবচেয়ে উত্তম পন্থা হলো দশ দিন ইতেকাফ করা। প্রিয় নবী (স.) মদিনায় আগমনের পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত কখনো ইতেকাফ ত্যাগ করেননি। হযরত আয়েশা (রাযি.) বলেন, রমজানের শেষ ১০ দিন রাসূল (স.) অধিক আমল করার উদ্দেশ্যে লুঙ্গি ভালো করে বেঁধে নিতেন, রাত জাগতেন, আর ঘরবাসীদেরকেও জাগাতেন। তাই আমাদের উচিত কদরের রাতকে গনিমত মনে করে প্রতিটি মুহূর্ত জিকির, তেলাওয়াত ও ইবাদতে মগ্ন থাকা, দুনিয়ার অনর্থক কথা-কাজ থেকে বিরত থাকা, দান-সাদাকা করা, খাঁটি তওবা করে গুনাহ মাফের জন্য দোয়া করা । কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য আমরা অনেকেই রমজানের শেষ দিকে এসে কেনা-কাটা ও ঈদ আনন্দ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। গাফিলতি ও অলসতায় শেষ দশকের মহামূল্যবান সময় নষ্ট হয়ে যায়।
আল্লাহ আমাদের সকলকে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পুরস্কার লাভের উদ্দেশ্যে ইতেকাফসহ বেশি বেশি ইবাদত-বন্দেগি করার তৌফিক দান করুন। আমিন, ছুম্মা আমিন।