আজ শুক্রবার, ১৩ Jun ২০২৫, ০৯:৫২ পূর্বাহ্ন

Logo
পবিত্র হজের গুরুত্ব, তাৎপর্য ও ফজিলত

পবিত্র হজের গুরুত্ব, তাৎপর্য ও ফজিলত

পবিত্র হজের গুরুত্ব, তাৎপর্য ও ফজিলত

পল্লী জনপদ ডেস্ক ॥

হজ আরবি শব্দ, যার অর্থ নিয়ত করা, দর্শন করা, সংকল্প করা, সন্ধান করা, সাক্ষাৎ করা, ইচ্ছা করা বা প্রতিজ্ঞা করাসহ কোনো মহৎ কাজের ইচ্ছা করা। ইসলামী শরিয়তের পরিভাষায় মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের ফরজ আমলটি পালনার্থে এবং আল্লাহর সান্নিধ্য ও সন্তোষ লাভের আশায় হজের নির্ধারিত সময়-সীমার ভেতরে নির্দিষ্ট আমল সম্পাদনের জন্য পবিত্র ‘বাইতুল্লাহ’ তথা কা’বা ঘর জিয়ারত করাকে হজ বলে।

মুমিন বান্দার প্রতি মহান আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ এই যে, তিনি তাকে এমন কিছু ইবাদত দান করেছেন, যা দ্বারা বান্দা তার রূহানি তারাক্কি, কলবের সুকুন ও প্রশান্তি এবং দুনিয়া-আখিরাতের খায়ের ও বরকত লাভ করে থাকে।

পবিত্র হজ ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের একটি। ঈমান, নামায, যাকাত ও রোযার পরই হজ্বের অবস্থান। হজ্ব মূলত কায়িক ও আর্থিক উভয়ের সমন্বিত একটি ইবাদত। তাই উভয় দিক থেকে সামর্থ্যবান মুসলিমের উপর হজ্ব পালন করা ফরয। অর্থাৎ হজ্ব আদায়ে সক্ষম এমন শারীরিক সুস্থতার পাশাপাশি নিত্যপ্রয়োজনীয় খরচাপাতি ও আসবাবপত্রের অতিরিক্ত হজ্বে যাওয়া-আসার ব্যয় এবং হজ্ব আদায়কালীন সাংসারিক ব্যয় নির্বাহে সক্ষম এমন সামর্থ্যবান ব্যক্তির উপর হজ্ব আদায় করা ফরয। হজ্ব প্রত্যেক মুসলমানের উপর সারা জীবনে একবারই ফরয হয়। একবার ফরয হজ্ব আদায়ের পর পরবর্তী হজ্বগুলো নফল হিসেবে গণ্য হবে।

বান্দার সঙ্গে আল্লাহর সেতুবন্ধনের উপায় হলো হজব্রত পালন। রাসূলে করিম (স.) বলেছেন, যে ব্যক্তি সঠিকভাবে হজ পালন করেন তিনি আগের সব গুনাহ থেকে নিষ্পাপ হয়ে যাবেন। মহান আল্লাহর সান্নিধ্য পাওয়ার উদ্দেশ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চল থেকে মুসলমানরা পবিত্র কাবা তাওয়াফ বা জিয়ারতের সংকল্প নিয়ে ছুটে আসেন বলেই এর নাম রাখা হয়েছে হজ।

আজ থেকে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার বছর আগে আল্লাহর নির্দেশে হজরত ইব্রাহিম (আ.) সর্বপ্রথম হজের প্রবর্তন করেন। এরপর থেকে নবী-রসুল পরম্পরায় চলে আসছে হজ পালনের বিধানটি। হজ প্রবর্তনের আগে হজরত ইব্রাহিম (আ.) আল্লাহর নির্দেশে পুত্র ইসমাইল (আ.)-কে সঙ্গে নিয়ে কাবাঘর পুনর্র্নির্মাণ করেন। কাবাঘর হজরত আদম (আ.) ফেরেশতাদের সহায়তায় সর্বপ্রথম নির্মাণ করেন। হজরত ইব্রাহিম (আ.) জিবরাইল (আ.)-এর সাহায্যে একই ভিতে অর্থাৎ হজরত আদম (আ.) কর্তৃক নির্মিত কাবার স্থানে এর পুনর্র্নির্মাণ করেন। নির্মাণকাজ শেষ হলে ইব্রাহিম (আ.)-এর প্রতি নির্দেশ হলো হজ পালনের। মহান আল্লাহ হজরত জিবরাইল (আ.)-এর মাধ্যমে তাঁকে হজের সব আহকাম সম্পর্কে অবহিত করেন। ইব্রাহিম (আ.) তাঁর পুত্র ইসমাইল (আ.)-কে নিয়ে কাবাঘর সাতবার তাওয়াফ করেন, চুম্বন করেন হাজরে আসওয়াদ এবং একে একে সম্পন্ন করেন হজের সব আহকাম।

এরপর আল্লাহ নির্দেশ দেন হজের দাওয়াত বিশ্ববাসীকে পৌঁছে দেওয়ার। এভাবেই শুরু হয় হজ। হজের মাধ্যমে স্থাপিত হয় বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর মহামিলনের সুন্দরতম এক দৃশ্য। নবম হিজরীতে হজ ফরজ হয়। হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লাম ১০ম হিজরিতে একবার স্বপরিবারে হজ পালন করেন। প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (স.) হজের ফজিলত সম্পর্কে বলেছেন, ‘বিশুদ্ধ ও মকবুল একটি হজ পৃথিবী ও পৃথিবীর যাবতীয় বস্তু অপেক্ষা উত্তম। বেহেশত ছাড়া আর কোনো কিছুই এর প্রতিদান হতে পারে না।’ দশম হিজরিতে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (স.) স্বয়ং হজের নেতৃত্ব দেন। হজ কীভাবে পালন করা উচিত তা তিনি নির্দিষ্ট করে দেন। আর্থিক ও শারীরিকভাবে সক্ষম নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রত্যেক মুসলমানের জন্য জীবনে অন্তত একবার হজ করা অবশ্য কর্তব্য। প্রতি বছর ৮ থেকে ১২ জিলহজ হজের আনুষ্ঠানিকতা পালিত হয়।

হজের সময় তালবিয়াহ নামক দোয়া পাঠ করা হয়। এটি হলো- ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক। লাব্বাইক লা-শারিকা লাকা লাব্বাইক। ইন্নাল হামদা ওয়ান নেয়ামাতা লাকা ওয়াল মুলকা। লা-শারিকা লাক।’ এর বাংলা অর্থ হলো- ‘হে আল্লাহ, আমি হাজির আছি, আমি হাজির আছি। আপনার কোনো শরিক নেই, আমি হাজির আছি। নিশ্চয় সকল প্রশংসা ও নেয়ামত আপনারই এবং সমগ্র বিশ্বজাহান আপনার। আপনার কোনো শরিক নেই।’

সাতবার তাওয়াফ :

পবিত্র কাবা শরিফের দক্ষিণ-পূর্ব থেকে শুরু করে সাতবার কাবা শরিফ প্রদক্ষিণ করাকে তাওয়াফ বলা হয়। কাবা শরিফ তাওয়াফ করা হজ ও ওমরাহর অন্যতম রুকন। হজ ও ওমরাহর তাওয়াফ ছাড়াও সারা বছর কাবা শরিফ তাওয়াফ করা অনেক বড় সওয়াবের কাজ। ওমরাহ ও হজের তাওয়াফ ব্যতীত নফল তাওয়াফও করা যায়।

মাথা মুণ্ডন বা চুল ছাঁটানো গুরুত্বপূর্ণ বিধান :

মাথার চুল মুন্ডন বা চুল ছাঁটা হজ ও ওমরাহর ওয়াজিব বিধান। মাথার চুল মুন্ডন বা কর্তন ছাড়া ইহরামের নিষেধাজ্ঞাগুলো শেষ হয় না। ওমরাহতে মাথা মুন্ডন করতে হয় সায়ি করার পর মারওয়ায় আর হজে কোরবানির পর মিনায়। চুল কাটার অর্থ হলো- পুরো মাথা থেকে কমপক্ষে এক আঙুলের এক কর পরিমাণ অথবা এক ইঞ্চি পরিমাণ কেটে ফেলা। মাথায় টাক থাকলে ব্লেড বা ক্ষুর মাথায় চালিয়ে দিলে ওয়াজিব আদায় হয়ে যাবে। নারীদের চুলের অগ্রভাগের কিছু অংশ কাটার নির্দেশ রয়েছে। নারীদের মাথা মুন্ডন করা হারাম। তারা পুরো মাথার চুল একত্রে ধরে এক আঙুল বা এক ইঞ্চি পরিমাণ কাটবেন। হজের ইহরাম থেকে হালাল হওয়ার জন্য মিনাতে বসে মাথা মুন্ডন করা সুন্নত। নাপিত দ্বারা কিংবা নিজেরাও চুল ছাঁটা যায়।

তিন শয়তানকে কঙ্কর নিক্ষেপ :

পবিত্র হজের অন্যতম ওয়াজিব বিধান হলো জামারায় কঙ্কর নিক্ষেপ করা। শয়তানকে উদ্দেশ করে হাজিরা তিনটি স্থানে কঙ্কর নিক্ষেপ করেন। জামারায় তিন শয়তানকে ঘৃণাভরে প্রতীকী অর্থে এ পাথর নিক্ষেপ করেন তাঁরা। এখানে কঙ্কর নিক্ষেপের পেছনে রয়েছে ঐতিহাসিক ঘটনা- মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে হজরত ইব্রাহিম (আ.) তাঁর প্রাণপ্রিয় শিশুপুত্র হজরত ইসমাইল (আ.)-কে নিয়ে চললেন কোরবানি করতে। শয়তান ভাবল, যদি হজরত ইব্রাহিম (আ.) এই পরীক্ষায় সফল হয়ে যান, তাহলে তিনি আল্লাহর আরও নিকটতম বান্দা হিসেবে পরিগণিত হবেন। তাই সে কোরবানির মহৎ উদ্দেশ্য পন্ড করার জন্য পিতা-পুত্র উভয়কে কুমন্ত্রণা দিতে থাকে। তখন হজরত ইব্রাহিম (আ.) কঙ্কর নিক্ষেপ করে ওই তিনটি স্থানেই শয়তানকে বিতাড়িত করেছিলেন। এ ঐতিহাসিক ঘটনার চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে মিনায় গিয়ে তিনটি স্থানে কঙ্কর নিক্ষেপ করেন হাজিরা, প্রথমত জামারাতুল আকাবা (শেষ জামারা), দ্বিতীয়ত জামারাতুল উস্তা (মধ্যম জামারা) এবং তৃতীয়ত জামারাতুল উলা (প্রথম জামারা)।

যে বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ-

ইহরাম : ইহরাম বাঁধা মূলত হজের নিয়ত করা। পুরুষের জন্য দুই টুকরো সেলাইবিহীন চাদর পরিধান করা এবং মাথা ও মুখমন্ডল খোলা রাখা হয়। মহিলাদের জন্য মুখ ও দুই হাতের কবজি পর্যন্ত খোলা রাখতে হয়।

সায়ি : সাফা ও মারওয়া পাহাড় দুটির মাঝে সাতবার প্রদক্ষিণ করাকে সায়ি বলা হয়।

হাদি : হজের কোরবানি (তামাত্তু ও কিরান আদায়কারীদের ওপর ওয়াজিব)।

তাওয়াফ : পবিত্র কাবাঘরকে সাতবার প্রদক্ষিণ করাকে তাওয়াফ বলে।

তাওয়াফে ইফাদা/জিয়ারাহ : হজের ফরজ তাওয়াফ যা আরাফাত, মুজদালিফা ও মিনার প্রথম দিনের কাজ শেষে মক্কায় এসে সম্পন্ন করতে হয়।

বিদায়ী তাওয়াফ : হজ বা ওমরাহর যাবতীয় কাজ শেষে মক্কা ত্যাগের পূর্বের তাওয়াফ।

ইজতেবা : পুরুষের ইহরামের চাদরকে ডান বগলের নিচে দিয়ে এনে বাম কাঁধে রেখে ডান কাঁধ খালি রাখা।

রমল : মক্কায় পৌঁছে প্রথম তাওয়াফের প্রথম তিন চক্করে পুরুষরা ছোট ছোট পদক্ষেপে সামান্য দৌড়ের ভঙ্গিতে দুই হাত দুলিয়ে চলা।

হাতিম : কাবাঘরের রুকনে ইয়ামেনি ও রুকনে শামির মাঝে দেয়াল ঘেরা অর্ধচক্রাকৃতি অংশ যা পূর্বে কাবাঘরের অংশ ছিল।

রমি : রমি অর্থ কঙ্কর নিক্ষেপ। হাজিরা ১০ জিলহজ বড় জামারায়, ১১ জিলহজ মেজ জামারায় ও ১২ জিলহজ ছোট জামারায় সাতটি করে কঙ্কর নিক্ষেপ করেন। কঙ্কর নিক্ষেপ করা ওয়াজিব।

দম : হজ বা ওমরাহ আদায়ে কোনো ওয়াজিব ছুটে গেলে অথবা ইহরাম নষ্ট হয় এমন কাজ করলে হারাম এলাকার ভিতরে একটি পশু কোরবানি করে গরিবদের মাঝে বিতরণ করতে হয়।

মাবরুর হজ : যে হজে হাজিকে কোনো গুনাহ স্পর্শ করে না এমন হজকে মাবরুর হজ বলে।

জান্নাতি পাথর হাজরে আসওয়াদ :

হাজরে আসওয়াদ পবিত্র কাবার দেয়ালে দক্ষিণ-পূর্ব কোণে দেড় মিটার উচ্চতায় স্থাপিত। মূল্যবান এই পাথর জান্নাত থেকে এসেছে। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেন, হাজরে আসওয়াদ জান্নাত থেকে অবতীর্ণ হয়েছিল। তখন সেটি ছিল দুধ থেকেও শুভ্র। মানুষের গুনাহ এটিকে এমন কালো করে দিয়েছে। (তিরমিজি, হাদিস : ৮৭৭; নাসায়ি, হাদিস : ২৯৩৫)। রসুলের (স.) নবুয়ত-পূর্ব সময়ে কাবা পুনর্র্র্নিমাণের পর হাজরে আসওয়াদ আগের স্থানে কে বসাবেন তা নিয়ে কোরাইশদের মধ্যে দ্বন্দ্ব বেধেছিল। তখন মহানবী (স.) নিজের গায়ের চাদর খুলে তাতে হাজরে আসওয়াদ রেখে সব গোত্রপ্রধানকে চাদর ধরতে বলেন। গোত্রপ্রধানরা চাদরটি ধরে কাবা চত্বর পর্যন্ত নিয়ে গেলে নবী করিম (স.) নিজ হাতে তা কাবার দেয়ালে স্থাপন করেন এবং দ্বন্দ্বের পরিসমাপ্তি ঘটান।

আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের আশায় কোরবানি :

পবিত্র হজের অংশ হিসেবে মিনায় শয়তানকে পাথর মারার পর তামাত্তু ও কিরান হজকারীর জন্য শুকরিয়াস্বরূপ কোরবানি করা ওয়াজিব। আরাফাতের ময়দানে অবস্থানের পরদিন জামারায় (প্রতীকী শয়তানকে পাথর নিক্ষেপের স্থান) পাথর মেরে হাজিদের পশু কোরবানি দিতে হয়। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য তামাত্তু ও কিরান হজ আদায়কারীরা যে উট, গরু, ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা ইত্যাদি পশু জবাই করে থাকেন তাকে হাদি বলা হয়। ১০ জিলহজ সূর্যোদয় থেকে শুরু করে ১৩ জিলহজ সূর্যাস্ত পর্যন্ত হাদি করা যায়।

তিন দিক পাহাড়বেষ্টিত আরাফাতের ময়দানে মহানবীর ঐতিহাসিক ভাষণ :

ভাষণ শেষে নবীজির (স.) চেহারা আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। উপস্থিত সাহাবিদের উদ্দেশ করে মহানবী (স.) বলেন, ‘আমি কি তোমাদের নিকট আল্লাহর দীনকে পরিপূর্ণ পৌঁছাতে পেরেছি?’ উপস্থিত লাখো সাহাবির কণ্ঠে সমস্বরে ধ্বনিত হয়, ‘হ্যাঁ, আপনি পেরেছেন’।

আরাফাত পবিত্র মক্কা নগরী থেকে ১৩-১৪ কিলোমিটার পূর্বে জাবালে রহমতের পাদদেশে হারামের সীমানার বাইরে অবস্থিত। ময়দানটি দৈর্ঘ্যে ২ কিলোমিটার এবং প্রস্থেও ২ কিলোমিটার। তিন দিক দিয়ে পাহাড়বেষ্টিত আরাফাতের ময়দান। দশম হিজরিতে রসুলুল্লাহ (স.) প্রায় সোয়া লাখ সাহাবিকে সঙ্গে নিয়ে হজ সম্পাদন করেন। বিদায় হজে হজরত মুহাম্মদ (স.) উপস্থিত সোয়া লাখ সাহাবির উদ্দেশে যে ভাষণ দিয়েছিলেন, তা বিদায় হজের ভাষণ নামে পরিচিত। এ ভাষণটি দশম হিজরি সনের ৯ জিলহজ আরাফার দিনে মসজিদে নামিরাতে ও জাবালে রহমতের ওপরে এবং পরদিন ১০ জিলহজ ঈদ ও কোরবানির দিন মিনাতে প্রদান করেছিলেন। নবী (স.)-এর দৃঢ় আশঙ্কা ছিল যে, এটাই তাঁর জীবনের সর্বশেষ হজ। ইসলামী শরিয়াহ মোতাবেক হজের যাবতীয় কার্যাবলি সম্পাদন শেষে, হজের দ্বিতীয় দিন ৯ জিলহজ মহানবী (স.) আরাফাতের ময়দানে সমবেত লক্ষাধিক সাহাবির সামনে জাবালে রহমতে দাঁড়িয়ে খুতবা দেন। মহানবী (স.)-এর এই ঐতিহাসিক ভাষণটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও হিকমতপূর্ণ। বিদায় হজের ভাষণে রসুলুল্লাহ (স.) অন্যায়ভাবে মানুষের রক্তপাত বন্ধ, সুদের কুফল, বর্ণবৈষম্যের ভয়াবহতা, স্বজনপ্রীতির বিরূপ প্রভাব, জাহেলি যুগের মানসিকতা পরিহার করার বিষয়ে জোরালো নির্দেশনা প্রদান করেছেন। নারীর অধিকার সংরক্ষণ ও তাদের মর্যাদার বিষয় তুলে ধরেছেন। সাম্যের ভিত্তিতে শ্রেণিবৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা, রাষ্ট্রের সব নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, ন্যায় ও ইনসাফভিত্তিক বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, শ্রমিকের অধিকার রক্ষা, পরমতসহিষ্ণু হওয়া, একনিষ্ঠভাবে কোরআন-সুন্নাহ অনুসরণের নির্দেশ দিয়েছেন। ভাষণে বিশেষভাবে গুরুত্ব পেয়েছে উম্মাহর ঐক্যের বিষয়টি। এ ভাষণে চারটি কথা তিনি বিশেষভাবে সবাইকে স্মরণে রাখতে বলেন- ‘১. আল্লাহ ছাড়া ভিন্ন কারও উপাসনা করবে না। ২. অন্যায়ভাবে কোনো মানুষকে হত্যা করবে না। ৩. অন্যের সম্পদ আত্মসাৎ করবে না। ৪. কারও ওপর জুলুম করবে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমার পর আমি তোমাদের জন্য দুটো জিনিস রেখে যাচ্ছি, তোমরা যতদিন তা আঁকড়ে ধরে থাকবে ততদিন পথভ্রষ্ট হবে না। ১. আল্লাহর বাণী অর্থাৎ পবিত্র কোরআনুল কারিম। ২. তাঁর প্রেরিত রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনাদর্শ।’

ভাষণ শেষে নবীজির (স.) চেহারা আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। উপস্থিত সাহাবিদের উদ্দেশ করে মহানবী (স.) বলেন, ‘আমি কি তোমাদের নিকট আল্লাহর দীনকে পরিপূর্ণ পৌঁছাতে পেরেছি?’ উপস্থিত লাখো সাহাবির কণ্ঠে সমস্বরে ধ্বনিত হয়, ‘হ্যাঁ, আপনি পেরেছেন।’ মহানবী (স.) আকাশের দিকে শাহাদাত আঙুল উঁচু করে তিনবার বললেন, ‘আল্লাহ আপনি সাক্ষী থাকুন, আল্লাহ আপনি সাক্ষী থাকুন, আল্লাহ আপনি সাক্ষী থাকুন, আমি আমার দায়িত্ব পালন করতে পেরেছি।’ সেদিন সেখানেই মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনের সর্বশেষ এ আয়াতটি অবতীর্ণ করেন, ‘আজ আমি তোমাদের দীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম এবং তোমাদের জন্য আমার নেয়ামতকে পরিপূর্ণ করে দিলাম। ইসলামকে তোমাদের জন্য একমাত্র জীবনব্যবস্থা হিসেবে মনোনীত করলাম।’ (সুরা মায়িদাহ, আয়াত-০৩)।

শিশুসম নিষ্পাপ হওয়ার সুযোগ :

হাজিরা হলেন আল্লাহর মেহমান। মেহমানের চাহিদা পূরণ করা, মেহমানের দোয়া কবুল করা মেজবানের কর্তব্য। হাদিস শরিফে হাজিদের আল্লাহর প্রতিনিধি দল বলা হয়েছে। তাদের দোয়া কবুল করা ও মাগফিরাতের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। রসুল (স.) বলেন, ‘হজ-ওমরাহকারীরা আল্লাহর প্রতিনিধি দল। তারা যদি তাঁর কাছে প্রার্থনা করে, তিনি তা কবুল করেন। আর যদি তাঁর কাছে ক্ষমা চায়, তিনি তাদের ক্ষমা করে দেন।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ২৮৯২)। হজ নিষ্পাপ হওয়ার মাধ্যম। রসুল (স.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশে হজ করল এবং এ সময় অশ্লীল ও গুনাহের কাজ থেকে বিরত থাকল, সে নবজাতক শিশুর মতো নিষ্পাপ হয়ে ফিরে আসবে।’ (বুখারি : ১৫২১)। রসুল (সা.) আরও বলেন, ‘তোমরা হজ-ওমরাহ সঙ্গে সঙ্গে করো। কেননা, এ দুটি দারিদ্র্য ও গুনাহ এভাবে দূর করে, যেভাবে হাঁপর লোহা ও সোনা-রুপার ময়লা দূর করে। আর মকবুল হজের বিনিময় জান্নাত।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ২৮৮৭)।

ইহরামে সেলাইবিহীন দুই টুকরো সাদা কাপড় পরতে হয় যাঁদের :

হজ ও ওমরাহ পালনে ইহরাম বাঁধা ফরজ। ইহরাম শব্দটির সহজ অর্থ হলো কোনো জিনিসকে নিজের ওপর হারাম বা নিষিদ্ধ করে নেওয়া। পুরুষদের জন্য সেলাইবিহীন দুই টুকরো সাদা কাপড় আর নারীদের জন্য স্বাচ্ছন্দ্যময় শালীন পোশাক পরিধান করাই হলো ইহরাম। এ কারণে হজ ও ওমরাহ পালনকারী পুুরুষ ইহরামের মাধ্যমে নিজের ওপর স্ত্রী সহবাস, মাথার চুল, হাতের নখ, গোঁফ, বগল ও নাভির নিচের ক্ষৌর কার্যাদি, সুগন্ধি ব্যবহার, সেলাই করা পোশাক পরিধান এবং শিকার করাসহ কিছু বিষয়কে হারাম করে নেয়। উল্লিখিত কাজগুলোর পাশাপাশি নারী-পুরুষ নির্বিশেষে হজ ও ওমরাহ এ দুটির মধ্যে যেটি আদায় করার ইচ্ছা করবে; তার নিয়ত করে চার ভাগে উচ্চৈঃস্বরে (নারীরা নিম্নস্বরে) তিনবার তালবিয়া পাঠ করাকেই ইহরাম বলে। নামাজের জন্য যেমন তাকবিরে তাহরিমা বাঁধা হয় তেমনি হজের জন্য ইহরাম বাঁধা হয়। ইহরামের মাধ্যমে হজ ও ওমরাহ পালনকারী ব্যক্তির জন্য স্বাভাবিক অবস্থার অনেক হালাল কাজও হারাম হয়ে যায়।

জমজমের কূপ এক বিস্ময় :

মুসলমানদের কাছে জমজমের পানি অতি বরকতময় ও পবিত্র। হাদিসে এ পানির অশেষ কল্যাণ ও বরকতের কথা উল্লেখ রয়েছে। মক্কার মাসজিদুল হারামের অভ্যন্তরে অবস্থিত জমজম কূপ। এই কূপের কাছে একটি শক্তিশালী পাম্প মেশিন বসানো হয়েছে। এই মেশিনের মাধ্যমে পানি উত্তোলন করা হয়। লাখ লাখ মানুষ তৃপ্তিভরে পানি পান করেন এবং পাত্রে ভরে নিয়ে যান। কাবা শরিফের বিভিন্ন জায়গায় পাইপলাইনের মাধ্যমেও জমজমের পানি সরবরাহের ব্যবস্থা রয়েছে। ইসলামের ইতিহাসে জমজম কূপের উৎপত্তি নিয়ে বর্ণনা রয়েছে। নবী ইব্রাহিম (আ.) তাঁর স্ত্রী হাজেরা (আ.) ও শিশুপুত্র ইসমাইল (আ.)-কে আল্লাহর আদেশে মক্কার বিরান মরুভূমিতে রেখে আসেন। তাঁর রেখে যাওয়া খাদ্য, পানীয় শেষ হয়ে গেলে হাজেরা (আ.) পানির সন্ধানে পার্শ্ববর্তী সাফা ও মারওয়া পাহাড়দ্বয়ের মাঝে ছোটাছুটি করেছিলেন। এ সময় হজরত ইসমাইল (আ.)-এর পায়ের আঘাতে ভূমি থেকে পানি বের হয়ে আসে। অন্য একটি বর্ণনানুসারে, আল্লাহ জিবরাইল (আ.)-কে সেখানে প্রেরণ করেন, জিবরাইলের পায়ের আঘাতে মাটি ফেটে পানির ধারা বেরিয়ে আসে। ফিরে এসে এই দৃশ্য দেখে হাজেরা (আ.) পাথর দিয়ে পানির ধারা আবদ্ধ করলে তা কূপে রূপ নেয়। জমজম কূপ বেশ কয়েকবার সংস্কার করা হয়। প্রথম থেকে এটি বালি ও পাথর দিয়ে ঘেরা অবস্থায় ছিল। পরবর্তীতে খলিফা আল মনসুরের সময় এর ওপর গম্বুজ এবং মার্বেল টাইলস বসানো হয়। পরবর্তীতে খলিফা আল মাহদি এটি আরও সংস্কার করেন। ২০১৭-১৮ সালে সৌদি বাদশাহ এটি সংস্কার করেন। বর্তমানে কূপটি কাবা চত্বরে দেখা যায় না। এটি ভূগর্ভস্থ অবস্থায় রাখা হয়েছে এবং কূপটি থেকে পাম্পের সাহায্যে প্রতিদিন ২০ লক্ষাধিক ব্যারেল পানি উত্তোলিত হয়। ইসলামের ইতিহাসে শৈশবে মহানবী (স.)-এর বক্ষ বিদারণ বা সিনা চাক করে কলিজার একটি অংশ বের করে তা এই জমজম কূপের পানিতে ধুয়ে আবার যথাস্থানে স্থাপনের ঘটনার বর্ণনা রয়েছে।

মহান আল্লাহ রব্বুল আলামিন আমাদের সকলকে পবিত্র হজব্রত সঠিক এবং সুন্দরভাবে পালন করার তাওফিক দান করুন। আমিন, ছুম্মা আমিন

শেয়ার করুন

© All rights reserved © 2017
Developed By

Shipon