আজ শুক্রবার, ১৩ Jun ২০২৫, ১০:৫৬ পূর্বাহ্ন

Logo
ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা শনাক্তে মাঠে জামুকা

ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা শনাক্তে মাঠে জামুকা

ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা শনাক্তে মাঠে জামুকা

পল্লী জনপদ ডেস্ক ॥

বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই বিতর্ক চলমান। এ পর্যায়ে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা শনাক্তে মাঠপর্যায়ে সরাসরি যাচাই-বাছাই কার্যক্রম শুরু করেছে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা)। এ লক্ষ্যে আজ (২ জুন) প্রথম ধাপে কুমিল্লা অঞ্চলের ৩১ জন সনদধারী মুক্তিযোদ্ধার বিরুদ্ধে শুনানি অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সকাল ১০টায় কুমিল্লা সার্কিট হাউজে শুরু হওয়া এই শুনানিতে অংশ নিচ্ছেন সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসন, অভিযোগকারী, স্থানীয় প্রবীণ ব্যক্তি ও অভিযুক্ত মুক্তিযোদ্ধা বা তাদের স্ত্রী-সন্তানরা।

জুলাই আন্দোলনের পর গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পাওয়া ফারুক-ই-আজম বীরপ্রতীক মুক্তিযোদ্ধা তালিকা ও সনদ যাচাইয়ের নির্দেশ দেন। এরপর থেকেই সারা দেশের জেলা-উপজেলা থেকে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে হাজার হাজার অভিযোগ জমা পড়ে। এসব অভিযোগ যাচাইয়ে মাঠ পর্যায়ে সরেজমিন তদন্তের সিদ্ধান্ত নেয় জামুকা।

জামুকার মহাপরিচালক শাহিনা খাতুন বলেন, “ঢাকায় বসে কারও আসল না ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা তা যাচাই করা অসম্ভব। এজন্যই মাঠপর্যায়ে যাচ্ছি। আমরা স্থানীয় সাক্ষ্যপ্রমাণ ও তথ্য বিশ্লেষণ করেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেব।”

জামুকা সদস্য খ. ম. আমীর আলী বলেন, “প্রত্যেক সরকার শুধু সনদ দিয়ে গেছে, যাচাই করেনি। তাই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান বাঁচাতে এখন ভুয়াদের বাদ দেওয়ার সময় এসেছে।”

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র জানায়, দেশে অন্তত ৯০ হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা রয়েছে। জামুকার হিসাবে এই সংখ্যা আরও বেশি—এক লাখেরও ওপরে। ১৯৯৪ সালে বিএনপি সরকারের করা ৮৬ হাজার আসল মুক্তিযোদ্ধার তালিকাকে এখন যাচাইয়ের ভিত্তি হিসেবে ধরা হয়েছে।

বর্তমানে সনদধারী মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ২ লাখ ৮ হাজার ৫০ জন, যার মধ্যে ভাতাপ্রাপ্ত ২ লাখ ৮ হাজার ৫০ জন এবং সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নিয়োগপ্রাপ্ত ৮৯ হাজার ২৩৫ জন।

যাচাই-বাছাইয়ের অংশ হিসেবে জামুকা শুনানিতে অংশ নিতে বলেছে: অভিযোগকারী মুক্তিযোদ্ধা ও স্থানীয় প্রবীণদের, মাঠ প্রশাসনের প্রতিনিধিদের, অভিযুক্ত মুক্তিযোদ্ধা বা তার স্ত্রী/সন্তানদের, যারা মুক্তিযুদ্ধকালীন ঘটনা, অবস্থান ও কার্যক্রমের তথ্য প্রমাণ উপস্থাপন করবেন।

গত ১৫ বছরে মুক্তিযোদ্ধার বয়সসীমা (১২ বছর ৬ মাস) পূরণ না করায় ২ হাজার ১১১ জনের সনদ বাতিল হয়েছে। সর্বমোট ৩ হাজার ৯২৬ জন মুক্তিযোদ্ধার গেজেট বাতিল হয়েছে নানা অনিয়ম ও ভুলের কারণে। বর্তমানে জামুকার কাছে বিচারাধীন ২ হাজার ৭১৯টি মামলা রয়েছে, যা প্রায় ১৪ ক্যাটাগরির মধ্যে বিভক্ত।

প্রথম ধাপে যে ৩১ জনের সনদ যাছাই : কুমিল্লায় অভিযোগ ওঠা যে ৩১ জনের মুক্তিযোদ্ধা সনদ যাচাইয়ে আজ শুনানি অনুষ্ঠিত হবে তারা হলেন ১. মো. সিরাজুল ইসলাম, পিতা-মৃত রহমত আলী, গ্রাম-কোয়ার, ডাকঘর-চানপাও, উপজেলা-লাকসাম, জেলা-কুমিল্লা, বেসামরিক গেজেট নং-৬৪০৪; ২. মো. সিরাজুল ইসলাম, পিতা-মৃত জমির উদ্দিন, গ্রাম-বাংলাপাহ, ডাকঘর-খিরন শালা বাজার, উপজেলা-চৌদ্দগ্রাম, জেলা-কুমিল্লা, বেসামরিক গেজেট নং-৬৬৪৯; ৩. মো. পেয়ার মিয়া, পিতা-মৃত মুন্সি মিয়া, গ্রাম-মেষতুলি, ডাকঘর-মেষতুলি, উপজেলা-চৌদ্দগ্রাম, জেলা-কুমিল্লা, বেসামরিক গেজেট নং-৭৬০৪; ৪. মো. হাবিবুর রহমান, পিতা-মৃত রেহান উদ্দিন, গ্রাম-মেষতুলি, ডাকঘর-উপজেলা-চৌদ্দগ্রাম, জেলা-কুমিল্লা, বেসামরিক গেজেট নং-৫৮৬৮; ৫. মো. আব্দুর রহিম, পিতা-মৃত আবিদ আলী, গ্রাম-পূর্ব ধারঘর, ডাকঘর-রায়কোট, উপজেলা-নাঙ্গলকোট, জেলা-কুমিল্লা, বেসামরিক গেজেট নং-২০৬৪; ৬. মো. আব্দুল কাদের, পিতা-মৃত আ. হামিদ, গ্রাম-চেংগাঁচাল, ডাকঘর-আড্ডাবাজার, উপজেলা-বরুড়া, জেলা-কুমিল্লা, বেসামরিক গেজেট নং-৮৪৪; ৭. মো. ওয়াহিদুর রহমান, পিতা-মৃত আলী আজম, গ্রাম-যশপুর, ডাকঘর মেষতুলি, উপজেলা-চৌদ্দগ্রাম, জেলা-কুমিল্লা; ৮. মো. জব্বার আলী, পিতা-মৃত আলীমুদ্দিন, গ্রাম-দারোরা, ডাকঘর-দারোরা, উপজেলা-জেলা-কুমিল্লা, বেসামরিক গেজেট নং-৭০২৮; ৯. আব্দুল হামিদ, পিতা-মৃত ছাদেকুর রহমান, গ্রাম-মিশ্রী কাজী বাড়ী, ডাকঘর-লাকসাম, উপজেলা-লাকসাম, জেলা-কুমিল্লা, বেসামরিক গেজেট নং-৭৪৬৭; ১০. মো. রমজান আলী, পিতা-মৃত রৌশন আলী, গ্রাম-শ্রীপুর, ডাকঘর-লাকসাম, উপজেলা-লাকসাম, জেলা-কুমিল্লা, বেসামরিক গেজেট নং-৭৫৬৬; ১১. মো. নুরুল হক মজুমদার, পিতা-মৃত শামসুল হক মজুমদার, গ্রাম-পোলইয়া, ডাকঘর-ইকবালনগর, উপজেলা-লাকসাম, জেলা-কুমিল্লা, বেসামরিক গেজেট নং-৬৫৫৬; ১২. বিনোদ বিহারী, পিতা-মৃত জগবন্ধু সাহা, গ্রাম-পশ্চিমগাঁও, ডাকঘর-পশ্চিমগাঁও, উপজেলা-লাকসাম, জেলা-কুমিল্লা, বেসামরিক গেজেট নং-৬৪৭৯; ১৩. মো. শহিদ উল্লাহ, পিতা-মৃত আজিজ উল্লাহ, গ্রাম-নরপাটি, ডাকঘর-ডোমবাড়িয়া, উপজেলা-লাকসাম, জেলা-কুমিল্লা, বেসামরিক গেজেট নং-৬২৩৪; ১৪. ডা. ফয়েজ আহম্মদ, পিতা-মৃত হাজী আছমত আলী, গ্রাম-কমড্ডা, ডাকঘর-আউসনপাড়া, উপজেলা-লাকসাম, জেলা-কুমিল্লা, বেসামরিক গেজেট নং-৬৭৬২; ১৫. বশিরুল আনোয়ার, পিতা-মৃত বালাগাত উল্যাহ, গ্রাম-বড়তুপা, ডাকঘর-বুরিয়াবিষ্ণুপুর, উপজেলা-লাকসাম, জেলা-কুমিল্লা, বেসামরিক গেজেট নং-৬৩৪২; ১৬. মোমতাজ উদ্দিন, পিতা-মৃত রজব আলী, গ্রাম-অশ্বতলা, ডাকঘর-পশ্চিমগাঁও, উপজেলা-লাকসাম, জেলা-কুমিল্লা, বেসামরিক গেজেট নং-৬২২৫; ১৭. মোহাম্মদ জব্বার আলী, পিতা-মৃত আলীমুদ্দিন, গ্রাম-পদুয়া, ডাকঘর-দারোরা বাজার, উপজেলা-মুরাদনগর, জেলা-কুমিল্লা; ১৮. মো. মোবারক হোসেন, পিতা-মৃত আব্দুর রহমান, গ্রাম-কাচারীকাান্দি, ডাকঘর-হোমনা, উপজেলা-হোমনা, জেলা-কুমিল্লা, বিমানবাহিনী গেজেট নং-৮৩৫; ১৯. মো. আবুল কাশেম প্রধান, পিতা-মৃত আব্দুর রাজ্জাক, গ্রাম-রামপুর, ডাকঘর-দরিচর, উপজেলা-হোমনা, জেলা-কুমিল্লা, গেজেট নং-৩০৭৪; ২০. হেলেনা বেগম, পিতা-আব্দুর রশিদ, গ্রাম-চান্দলাহুড়ারপাড়, ডাকঘর-চান্দলা, উপজেলা-ব্রাহ্মণপাড়া, জেলা: কুমিল্লা, গেজেট নং-৫২০৩; ২১. মো. রব্বান মিয়া, পিতা-মৃত কালা মিয়া, গ্রাম-মানরা, ডাকঘর-শশীদল, উপজেলা-ব্রাহ্মণপাড়া, জেলা-কুমিল্লা, গেজেট নং-৬৬৫৩; ২২. জহিরুল ইসলাম ভূঁইয়া, পিতা মো. নেয়াজ আলী ভূঁইয়া, গ্রাম-গৌরাংগুলা, ডাকঘর-বিদ্যানগর, উপজেলা-কসবা, জেলা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া, গেজেট নং-৪২৯০; ২৩. আপেল মাহমুদ, পিতা-এম.এ রহমান, গ্রাম-মুন্সীপাড়া, ডাকঘর-সোনারচর, থানা-দাউদকান্দি, জেলা-কুমিল্লা, গেজেট নম্বর-৭; ২৪. কৃষ্ণা সাহা, পিতা-যোগেশ চন্দ্র চক্রবর্তী, গ্রাম-কুমিল্লা রোড, ডাকঘর-চাঁদপুর সদর, জেলা-চাঁদপুর, গেজেট নম্বর-২৮৬; ২৫. গীতশ্রী চৌধুরী, পিতা-মৃত অসিত রঞ্জন চৌধুরী, কান্দিরপাড় নজরুল অ্যাভিনিউ রোড, ডাকঘর-কুমিল্লা সদর, উপজেলা-কুমিল্লা সদর, জেলা-কুমিল্লা, গেজেট নম্বর-২১৭; ২৬. শিপ্রা রানী সাহা, পিতা-মনীন্দ্র কুমার সাহা, গ্রাম-মনিপুর, ডাকঘর-চৌমুহনী, উপজেলা-বেগমগঞ্জ, জেলা-নোয়াখালী, গেজেট নম্বর-২৮৮; ২৭. মো. আব্দুল মালেক, পিতা-মৃত মো. রৌশন আলী, গ্রাম-বাবুটিপাড়া, ডাকঘর-ইলিয়টগঞ্জ, উপজেলা-মুরাদনগর, জেলা-কুমিল্লা, গেজেট নম্বর-২৬৯৩; ২৮. মো. মুকবুল হোসেন মুকুল, পিতা-মো. রফিজ মিয়া, গ্রাম-ইসলামপুর, ডাকঘর-কুমিল্লা সদর, উপজেলা-কুমিল্লা আদর্শ, জেলা-কুমিল্লা, ২৯. মো. মিনহাজুল ইসলাম, পিতা-মো. রশিদ আহম্মেদ, গ্রাম-বাশপর, ডাকঘর-কেনেল পাড়, উপজেলা-বরুড়া, জেলা-কুমিল্লা, বেসামরিক গেজেট নং-৬৬০১; ৩০. মো. মোজাফফর আহম্মদ, পিতা-মৃত আব্দুল মজিদ প্রধান, গ্রাম-মনিপুর, ডাকঘর-মনিপুর, উপজেলা-হোমনা, জেলা-কুমিল্লা, বেসামরিক গেজেট নং-৬৫৫৯ এবং ৩১. মো. আবুল কাশেম (মো. আবুল কালাম আজাদ) পিতা-আলিম উদ্দিন, গ্রাম-হটাশ, ডাকঘর-বাংগরা বাজার, উপজেলা-মুরাদনগর, জেলা-কুমিল্লা, বেসামরিক গেজেট নং-৭৪৬৮।

মন্ত্রণালয়ের লক্ষ্য একটি নির্ভরযোগ্য মুক্তিযোদ্ধা ডেটাবেজ তৈরি করা, যাতে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত না হয়। ধাপে ধাপে দেশের সব জেলার ভুয়া সনদধারীদের যাচাই করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এই উদ্যোগকে অনেকেই স্বাগত জানিয়েছেন। কারণ, দীর্ঘদিন ধরে ভুয়া সনদের অপব্যবহারে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা বঞ্চিত হচ্ছিলেন সম্মান ও সুবিধা থেকে। এখন যদি এই যাচাই কার্যক্রম সফল হয়, তবে দেশের ইতিহাসের একটি বড় অবিচার হয়তো শেষমেশ সংশোধনের পথে যেতে পারে।

শেয়ার করুন

© All rights reserved © 2017
Developed By

Shipon