আজ বৃহস্পতিবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:৪৮ অপরাহ্ন
পল্লী জনপদ ডেস্ক ॥
বাংলাদেশে গণআন্দোলনের মুখে ক্ষমতা হারানোর তিন মাস পরেও নিজেদের কৃতকর্মের বিষয়ে আওয়ামী লীগে কোনো অনুশোচনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। বরং পুরো বিষয়টিকে এখনো ‘ষড়যন্ত্র’ হিসেবেই মনে করে দলটি।
বিশেষ করে, গত জুলাই-অগাস্টের ছাত্র আন্দোলন দমনে যেভাবে শক্তি প্রয়োগ করা হয়েছে এবং তাতে যত প্রাণহানি হয়েছে, সেটির দায় স্বীকার করে এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করতে দেখা যায়নি দলটিকে।
দলটির শীর্ষ নেতারা এখনও বিশ্বাস করেন করেন যে, গণঅভ্যুত্থানের নামে “পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের” মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে উৎখাত করে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে।
একই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে দলটির সভাপতি শেখ হাসিনাসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের নামে মামলা দিয়ে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো এবং আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি তোলা হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেছেন নেতারা।
তবে এসবের মধ্যেই অগাস্ট পরবর্তী সাংগঠনিক বিপর্যয় কাটিয়ে দলটি আবারও ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে।
দেশে-বিদেশে আত্মগোপনে থাকা নেতাকর্মীদের মধ্যে ইতোমধ্যেই যোগাযোগের একটি নেটওয়ার্ক তৈরি হয়েছে বলেও জানিয়েছেন নেতারা। তৃণমূলে কেউ কেউ এলাকায়ও ফিরতে শুরু করেছেন।
কর্মী-সমর্থকদের মনোবল চাঙ্গা করতে গণঅভ্যুত্থানের তিন মাস পর সম্প্রতি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম কর্মসূচি দিতে দেখা গেছে আওয়ামী লীগকে।
তবে এখনই সরকারবিরোধী আন্দোলনে নামার পরিকল্পনা নেই বলে শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যাচ্ছে।
বরং দ্রব্যমূল্য, আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণসহ বিভিন্ন ইস্যুতে সাধারণ মানুষের মধ্যে এখনও যে হতাশা ও অসন্তোষ দেখা যাচ্ছে, সেটি সামনে আরও বেড়ে অন্তর্বর্তী সরকার কতদিনে জনসমর্থন হারায়, আপাতত সেটিই দেখার অপেক্ষা করছেন তারা।
তবে বিদেশে ‘আত্মগোপনে’ থেকে শীর্ষ নেতাদের বাংলাদেশে কর্মসূচি ঘোষণা করা নিয়ে দলটির তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের অনেকের ক্ষোভ দেখা গেছে। তারা বলছেন, এর মাধ্যমে তারা দেশে নেতা-কর্মীদের আরও বিপদের মুখে ফেলছেন।
যদিও বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকার ব্যর্থ হলেও নিজেদের কৃতকর্মের জন্য জনগণের কাছে ক্ষমা না চাইলে মাঠের রাজনীতিতে ফেরা আওয়ামী লীগের জন্য কঠিন হবে।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থানকে শুরু থেকেই ‘পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র” হিসেবে চিহ্নিত করে আসছে আওয়ামী লীগ। গত জুলাইয়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন চলাকালে দেশে সহিংস পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাই প্রথম ষড়যন্ত্রের কথা উল্লেখ করেন।
“এটা যে একটা বিরাট চক্রান্ত, সেটা বোঝাই যাচ্ছিল,” গত ২৪শে জুলাই সাংবাদিকদের বলেন শেখ হাসিনা।
ক্ষমতা হারানোর তিন মাস পরেও আওয়ামী লীগ একই কথা বলছে।
“এটা (গণঅভ্যুত্থান) যে একটা পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র ছিল, ইউনূস সরকারের কথাবার্তা ও কাজ-কর্মেই সেটি ক্রমেই পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম।
তিনি আরও বলেন, “সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিজেও সে কথা স্বীকার করেছেন।”
উল্লেখ্য যে, গত সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্কে ‘ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভে’র একটি অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সেখানে তিনি বলেন, “এ (বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের) আন্দোলন খুব পরিকল্পিতভাবে চালিয়ে নেওয়া হয়েছে। কিছুই হঠাৎ হয়নি।”
আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করে যে, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে সরকাবিরোধিতায় রূপ নেওয়ার ক্ষেত্রে বিএনপি-জামায়াতের পাশাপাশি বিদেশি শক্তিরও ভূমিকা রয়েছে।
“স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় যারা বাংলাদেশের বিরোধিতা করেছে, তারাই এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত। বাংলাদেশকে তারা ব্যর্থ রাষ্ট্র প্রমাণ করতে চায়,” বলছিলেন সাবেক নৌপ্রতিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী।
গত পাঁচই অগাস্টের পর ভারতীয় বার্তা সংস্থা এএনআইকে দেওয়া সাক্ষাৎকারেও একই কথা জানিয়েছিলেন শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়।
“আমি এখন দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, (আন্দোলনকারী) ছোট গোষ্ঠীটি বিদেশি একটি গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে প্ররোচিত হয়েছিল। আমি (পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা) আইএসআইকে প্রবলভাবে সন্দেহ করি।”
যদিও এর আগেও বিভিন্ন সময় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এমন ষড়যন্ত্রের কথা বহু বার বলা হয়েছে। কিন্তু টানা দেড় দশক ক্ষমতায় থাকার পরও আওয়ামী লীগ কেন কথিত সেই ষড়যন্ত্র রুখতে ব্যর্থ হলো?
“ষড়যন্ত্র হচ্ছে সেটা আমরা জানতাম। কিন্তু কোটা ইস্যু ধরে সেটি যে এতদূর গড়াতে পারে, ওইটা আমরা কেউই ভাবতে পারিনি। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা বাহিনীগুলোও পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে,” বিবিসি বাংলাকে বলেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মি. নাছিম।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমনে গত জুলাই-অগাস্টে শেখ হাসিনার সরকার যেভাবে বলপ্রয়োগ করেছে এবং তাতে যত মানুষ হতাহত হয়েছে, স্বাধীন বাংলাদেশে ইতিহাসে সেটি নজিরবিহীন।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রাথমিক তালিকা অনুযায়ী, আন্দোলন চলাকালে তিন সপ্তাহে সাড়ে আটশ’র বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন, যাদের বেশিরভাগই মারা গেছেন গুলিতে।
এছাড়া আহত হয়েছেন ২০ হাজারেরও বেশি। তাদের মধ্যে অনেকেই হাত, পা এবং চোখ হারিয়েছেন; পঙ্গুত্বও বরণ করেছেন কেউ কেউ।
কিন্তু হতাহতের এসব ঘটনার পুরো দায় নিতে চায় না আওয়ামী লীগ।
“শুরু থেকেই আমরা বলে আসছিলাম যে, এই আন্দোলনে একটা তৃতীয়পক্ষ রয়েছে, যাদের গুলিতে সাধারণ মানুষ নিহত হয়েছে,” বিবিসি বাংলাকে বলেন মি. নাছিম।
পরিকল্পিত যেই ‘ষড়যন্ত্রে’র কথা আওয়ামী লীগ বলছে, সেটির অংশ হিসেবেই এটি কথা হয়েছে বলে মনে করেন দলটির নেতারা।
“সরকারের একজন উপদেষ্টাও তো এই কথা স্বীকার করেছেন যে, সেভেন পয়েন্ট সিক্স টু রাইফেল বাংলাদেশের পুলিশ ব্যবহার করে না, অথচ সেই অস্ত্র দিয়ে সাধারণ মানুষের ওপর গুলি চালানো হয়েছে,” বলেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মি. নাছিম।
উল্লেখ্য যে, অন্তবর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর গত ১২ই অগাস্ট তৎকালীন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন ঢাকা সিএমএইচ হাসপাতালে আহত আনসার সদস্যদের দেখতে গিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, “আহত আনসার সদস্যদের বক্তব্য শুনে আমার কাছে আশ্চর্য লাগছে। পুলিশের ফায়ার (গুলি) কম লাগছে তাদের। সিভিলিয়ান পোশাকে ৭.৬২ রাইফেলের গুলি লেগেছে। ম্যাসিভ ইনভেস্টিগেশন দরকার। এরা কারা? কাদের হাতে সেভেন পয়েন্ট সিক্স টু রাইফেল গেলো?”
যদিও পরে মি. হোসেন দাবি করেন যে, গণমাধ্যমে তাকে ভুলভাবে উদ্ধৃত করা হয়েছে।
“আমি বলেছিলাম, পুলিশের কাছে সেভেন পয়েন্ট সিক্স টু রাইফেল কারা দিয়েছে, এটা প্রথম আমি তদন্ত করবো…এমনকি আমি এ কথাও বলেছিলাম, সিভিলিয়ানদের হাতে আমি এই রাইফেল দেখেছি। দে আর নট পার্ট অব পুলিশ। আমি সেটাও তদন্তের কথা বলেছিলাম,” গত ১৪ই সেপ্টেম্বর ঢাকায় একটি অনুষ্ঠানে বলেন মি. হোসেন।
তবে জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহ থেকেই ‘তৃতীয়পক্ষের গুলি’ চালানোর বিষয়ে কথা বলে আসছিলো আওয়ামী লীগ। তাহলে তখন কেন তাদের দাবি অনুযায়ী ওই ‘পক্ষটি’কে শনাক্ত করা সম্ভব হলো না।
“সেটার কথা অবশ্যই মাথায় ছিল। কিন্তু তখন দেশে যে অস্থির পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছিল, সেটি সামাল দেওয়াকেই সরকার বেশি প্রাধান্য দিয়েছিল,” বলেন মি. নাছিম।
আওয়ামী লীগ এসব কথা বললেও পুলিশ, বিজিবি ও দলটির বন্দুকধারী নেতাকর্মীরা যে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালিয়েছে, সেটার অসংখ্য ছবি ও ভিডিও তখনই সামনে এসেছে। এমনকি “পুলিশের পোশাক পরে সন্ত্রাসীরা গুলি চালিয়েছে” এমন বক্তব্যও তখন এসেছে আওয়ামী লীগের মন্ত্রীদের মুখ থেকে।
“এরকম ঘটনা যে একেবারেই ঘটেনি, সেটা তো আমরা অস্বীকার করছি না। ঘটনাগুলোর তদন্তও তো আমরা শুরু করেছিলাম। সেগুলোর তদন্ত শেষ করলেই কার কতটুকু দায়, সেটা পরিষ্কার হয়ে যাবে,” বিবিসি বাংলাকে বলেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মি. নাছিম।
গণঅভ্যুত্থানকে ‘পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র’ বললেও টানা দেড় দশক ক্ষমতায় থাকাকালে আওয়ামী লীগ যে কিছু ভুল করেছে, সেটি অবশ্য স্বীকার করছেন দলটির শীর্ষ নেতারা।
“আওয়ামী লীগ তো আসমান থেকে আসা কোনো দল না। আমরা সবাই মানুষ। কাজেই দেশ পরিচালনার সময় কিছু ভুল হওয়া স্বাভাবিক। কিছু ভুল-ত্রুটি তো ছিলই,” বলছিলেন বাহাউদ্দিন নাছিম।
আওয়ামী লীগের গত ১৫ বছরের শাসনামলে বড় একটি অভিযোগ ছিল মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে। বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসেবে, ওই সময় ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বা ‘ক্রসফায়ারের’ নামে অন্তত এক হাজার ৯২৬ জন মানুষ বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন।
এর বাইরে, অসংখ্য মানুষ গুমের শিকার হয়েছেন, যাদের কেউ কেউ শেখ হাসিনার পতনের পর এখন ফিরেও আসছেন। যদিও গুম হওয়া ব্যক্তিদের একটি বড় অংশের এখনও কোনো সন্ধান পায়নি পরিবার।
এর বাইরে, অনিয়ম-দুর্নীতি, জমি দখল, বিদেশে বিপুল অর্থপাচারসহ আরও অনেক অভিযোগ সামনে এসেছে।
আওয়ামী লীগের গত তিন মেয়াদের শাসনামলে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছরে গড়ে ১২ থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হয়েছে বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান।
অর্থপাচার করে আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী-এমপিদের অনেকে বিদেশে বিপুল সম্পত্তির মালিকও হয়েছেন।
“আমরা এখন আত্ম-সমালোচনা করছি। যেসব ভুল আমরা করেছি, সেগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে এখন সামনে এগুতে চাই,” বলছিলেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মি. নাছিম।
এক্ষেত্রে অনিয়ম-দুর্নীতি, জমি দখল, অর্থপাচারসহ অন্যান্য অপরাধের সঙ্গে যুক্ত নেতাদের বিরুদ্ধে কি কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে?
“আওয়ামী লীগ সবসময়ই এগুলো বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে ছিল, থাকবে। কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে, সেটা দলের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে,” বলেন মি. নাছিম।
গত পাঁচই অগাস্ট ক্ষমতা ছেড়ে শেখ হাসিনা আকস্মিকভাবে ভারতে চলে যাওয়ার পর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা রীতিমত দিশেহারা হয়ে পড়েন।
এর মধ্যেই বিভিন্ন স্থানে দলটির কার্যালয়, নেতাকর্মীদের বাড়ি-ঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলার ঘটনা ঘটতে থাকে।
ফলে জীবন ‘বাঁচাতে’ আত্মগোপনে যাওয়া ছাড়া উপায় ছিল না বলে জানাচ্ছেন আওয়ামী লীগ নেতারা।
“আমাদেরকে আত্মগোপনে যেতে বাধ্য করা হয়েছে। যেভাবে হামলা ও হত্যা করা শুরু হয়েছিল, তাতে আত্মগোপনে যাওয়া ছাড়া উপায় ছিল না,” বলছিলেন মি. নাছিম।
গত তিন মাসে ‘আত্মগোপনে’ থাকা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে অনেকেই গ্রেফতার হয়েছেন। কেউ কেউ দেশও ছেড়েছেন।
এদিকে, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে দুই শতাধিক মামলা হয়েছে, যেগুলোর বেশিরভাগই হত্যা মামলা।
একইভাবে, দলটির অন্যান্য নেতাকর্মীদেরকেও অসংখ্য মামলায় আসামি করা হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে।
“আমাদের নেত্রীসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে বানোয়াট ও ভিত্তিহীন মামলা দেওয়া হয়েছে,” বিবিসি বাংলাকে বলেন আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক নৌপ্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী।
জুলাই থেকে গত চার মাসে হামলায় দলটির কয়েকশ নেতাকর্মী নিহত হয়েছে বলে দাবি করেছে আওয়ামী লীগ।
“ইতোমধ্যেই আহত-নিহতদের তথ্য সংগ্রহ আমরা শুরু করেছি,” বলেন মি. চৌধুরী।
সন্ত্রাসী সংগঠন ঘোষণা দিয়ে সম্প্রতি আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।
বাতিল করা হয়েছে ১৫ই অগাস্টের শোক দিবস, সংবিধান দিবসসহ জাতীয় আটটি দিবস।
এখন ‘গণহত্যার’ অভিযোগে আওয়ামী লীগ সভাপতিসহ অন্য নেতাদের বিচার করার উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে। এমনকি দল হিসেবে আওয়ামীকে নিষিদ্ধও করারও দাবি করছেন অনেকে।
“এগুলোর সবই ষড়যন্ত্রের অংশ,” বলছিলেন মি. চৌধুরী।
আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করার উদ্দেশ্যেইএসব করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন তিনি।
“অতীতেও এমন চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু কেউ আওয়ামী লীগকে দাবাতে পারেনি, এরাও পারবেন না,” বলেন মি. চৌধুরী।
পাঁচই অগাস্টের পর নেতারা ‘আত্মগোপনে’ চলে যাওয়ায় নেতৃত্বশূন্যতায় চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়েছিল আওয়ামী লীগ।
তিন মাস পর সেই বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে দলটি। দেশে-বিদেশে ‘আত্মগোপনে’ থাকা নেতাদের মধ্যে যোগাযোগের একটি নেটওয়ার্ক তৈরি হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে।
“নিয়মিতভাবেই এখন আমাদের নেতাকর্মীদের মধ্যে যোগাযোগ হচ্ছে, আলাপ-আলোচনা হচ্ছে,” বিবিসি বাংলাকে বলেন আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী।
এমনকি তৃণমূলের নেতাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার একাধিক ফোনালাপও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তে দেখা গেছে। যদিও ফোনালাপগুলোর আসল কি না, বিবিসির পক্ষে স্বাধীনভাবে সেটি যাচাই করা সম্ভব হয়নি।
তবে দলীয় সভাপতির সঙ্গে যে যোগাযোগ হচ্ছে, সেটি অবশ্য স্বীকার করছেন নেতারা।
“শুধু নেতাদের সঙ্গেই না, সাধারণ কর্মী ও মানুষের সঙ্গেও আমাদের নেত্রীর যোগাযোগ রয়েছে। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তিনি আলাপ-আলোচনা করছেন এবং নির্দেশেনা দিচ্ছেন,” বলেন মি. চৌধুরী।
মূলত দলের ‘দিশেহারা’ নেতাকর্মীদের মনোবল চাঙ্গা করে ‘বিপর্যস্ত’ আওয়ামী লীগকে ফের সংগঠিত করার উদ্দেশ্যেই শেখ হাসিনা সরাসরি কথা বলছেন বলে জানাচ্ছেন তার দলের নেতারা।
একইসঙ্গে, দলের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ ও এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডেলেও এখন আওয়ামী লীগকে বেশ সক্রিয় ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে।
দলকে সংগঠিত করাই এখন আওয়ামী লীগের মূল লক্ষ্য। সে লক্ষ্যেই দশই নভেম্বর ঢাকার গুলিস্তানে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে নূর হোসেন দিবস পালনের ডাক দেয় আওয়ামী লীগ।
যদিও দলটির কর্মী-সমর্থকদের সেভাবে মাঠে নামতে দেখা যায়নি। এরপরও অল্প যে কয়েকজন সেখানে গিয়েছিলেন, তারা হামলা ও মারধরের শিকার হয়েছেন।
“এই সরকার আওয়ামী লীগকে ফ্যাসিস্ট বলে। অথচ তারা নিজেরাই যে সবচেয়ে বড় ফ্যাসিস্ট, মানুষ সেটি দেখেছে। দেখেছে, কীভাবে আমাদের কর্মীদের উপর হামলা হয়েছে,” বলছিলেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মি. নাছিম।
সাম্প্রতিক এই কর্মসূচির মাধ্যমে দলকে সংগঠিত করার পাশাপাশি অন্তর্বর্তী সরকার, সাধারণ মানুষ ও রাজনৈতিক দল কী প্রতিক্রিয়া দেখায়, সেটিও বুঝতে চেয়েছে আওয়ামী লীগ।
এবার যে অভিজ্ঞতা তাদের হয়েছে, সেটির প্রেক্ষিতেই দলটি আগামীর কর্মসূচি গ্রহণ করবে। তবে আপাতত সরকারবিরোধী বড় কোনো কর্মসূচিতে যাওয়ার পরিকল্পনা দলটির নেই বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন নেতারা।
“আত্মগোপনে থাকার পরও আমাদের নেতাকর্মীদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় গণমানুষের জন্য যে ধরনের কর্মসূচি গ্রহণ করা প্রয়োজন, সেটাই আমরা গ্রহণ করবো,” বলছিলেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মি. নাছিম।
কিন্তু নেতারা যেখানে ‘আত্মগোপনে’, সেখানে কর্মীদের দিয়ে কি কর্মসূচি সফল করা যাবে?
“আওয়ামী লীগ কর্মী নির্ভর রাজনৈতিক দল। ফলে কে নেতা বা তারা কোথায়, সেটা বড় কথা না,” বিবিসি বাংলাকে বলেন মি. চৌধুরী।
কর্মসূচি দেওয়ার ক্ষেত্রে ‘ধীরে চলো নীতি’তে সামনে এগোতে চায় আওয়ামী লীগ।
“আওয়ামী লীগ কখনো ফুরিয়ে যায়নি, আওয়ামী লীগ ফুরিয়ে যাবেও না। আওয়ামী লীগ সচেতনভাবেই এখন চুপ আছে,” সম্প্রতি যুক্তরাজ্যভিত্তিক বাংলা গণমাধ্যম চ্যানেল এসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদ।
তিনি আরও বলেন, “এখন যদি আমরা রাজনৈতিক কর্মসূচি দিয়ে (মাঠে) নামতাম, তাহলে সরকারের পক্ষ থেকে আবার অনেকে বলেতো যে, আমাদের কারণে তারা রাষ্ট্র পরিচালনা করতে পারছে না…আমরা একটু নিশ্চুপ আছি, যাতে আমাদের ওপর দোষ না আসে।”
অন্তর্বর্তী সরকার কখন ব্যর্থ প্রমাণিত হয়, দলটি এখন সেই অপেক্ষায় রয়েছে।
“দেশের ক্ষতি করার জন্য এরা যে মিথ্যা বলে ও ষড়যন্ত্র করে ক্ষমতা দখল করেছে, সেটা জনগণ বুঝে গেছে। খুব শিগগিরই এদের পতন ঘটবে,” বিবিসি বাংলাকে বলেন আওয়ামী লীগ নেতা খালিদ মাহমুদ চৌধুরী।
গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পর হামলার ভয়ে দেশের বেশিরভাগ এলাকায় দলটির নেতাকর্মীরা গা ঢাকা দিয়েছিলেন।
গত তিন মাসে পরিস্থিতি অনেকটাই শান্ত হয়ে আসায় তাদের কেউ কেউ নিজ এলাকায় ফিরতে শুরু করেছিলেন।
কিন্তু সম্প্রতি আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কর্মসূচি ঘোষণার পর আবারও ঘর ছাড়তে হয়েছে বলে জানাচ্ছেন তৃণমূলের নেতাকর্মীরা।
“নিজেরা নিরাপদে থেকে বিদেশে বসে বসে নেতারা যে কর্মসূচি ঘোষণা করছেন, তারা কি আমাদের কথা ভাবেন? ভেবে থাকলে এমন কর্মসূচি তারা এখন কীভাবে ঘোষণা করেন?,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন আওয়ামী লীগের উপজেলা পর্যায়ের একজন নেতা।
একই সুরে কথা বলেছেন তৃণমূলের অন্য নেতারাও। পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত তারা দলীয় কোনো কর্মসূচিতেই অংশ নিবেন না বলে জানিয়েছেন।
“দলের জন্য যথেষ্ঠ ত্যাগ স্বীকার করেছি। তাতে লাভ কী হয়েছে? মার খাই আমরা, রক্ত দিই আমরা, আর হাইব্রিড নেতারা এসে অর্থ-সম্পদের মালিক হয়,” বলছিলেন দক্ষিণবঙ্গের একটি জেলার ইউনিয়ন পর্যায়ের এক নেতা।
তিনি অবশ্য এখনও এলাকাতেই অবস্থান করছেন।
“এলাকাতেই আছি। কিন্তু বাড়ির বাইরে খুব একটা বের হই না,” বলছিলেন তিনি।
তারা দু’জনই মনে করেন যে, জুলাই-অগাস্টের ছাত্র আন্দোলন দমনে সরকার ও দলের বিতর্কিত ভূমিকার জন্য আওয়ামী লীগের দুঃখপ্রকাশ করা উচিৎ।
“ভুল যে হয়েছে, সেটা তো অস্বীকার করার উপায় নাই। এখন টপ লিডারদের ভুলের খেসারত দিতে হচ্ছে আমাদের,” বলছিলেন দক্ষিণবঙ্গের তৃণমূল নেতা।
“কিন্তু এভাবে কতদিন? তৃণমূলের নেতাকর্মীদের কথা বিবেচনা করে হলেও দলের উচিৎ দুঃখপ্রকাশ করা,” বলেন তিনি।
তৃণমূলের নেতারা কেউই তাদের নাম প্রকাশ করতে চাননি।
ভুল স্বীকার করে ক্ষমা না চাইলে রাজনীতির মাঠে ফেরা আওয়ামী লীগের জন্য কঠিন হবে বলে জানাচ্ছেন বিশ্লেষকরা।
“রাজনীতিতে ফিরে আসতে হলে আওয়ামী লীগকে জনগণের ম্যান্ডেট নিয়েই ফিরে আসতে হবে। আর সেজন্য কর্তৃত্ববাদী শাসনের চালানোর জন্য ভুক্তভোগী সাধারণ জনগণের কাছে আওয়ামী লীগের ক্ষমা চাওয়া উচিৎ,” এসব কথাগুলো বলছিলেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. জোবাইদা নাসরিন।
একই অভিমত দিয়েছেন আরেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও লেখক মহিউদ্দিন আহমদ।
তিনি বলেন- “ক্ষমা চাইলে তো এদেশের মানুষ ক্ষমা করে দেয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, আওয়ামী লীগ এখনও ক্ষমা চায়নি এবং চাইবে বলেও মনে হচ্ছে না। কারণ ক্ষমা চাইলে তাদের রাজনীতিটা আর থাকে না”।
সূ্ত্র : বিবিসি বাংলা