আজ রবিবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৪, ১১:৪০ অপরাহ্ন
পল্লী জনপদ ডেস্ক ॥
একটি প্রকল্পের আওতায় ছয় কোটির বেশি টাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরাল তৈরি করে বাংলাদেশ বেতার। চলতি (সেপ্টেম্বর) মাসে উদ্বোধন হওয়ার কথা ছিল। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বেতারের অন্য স্থাপনার সুরক্ষায় নিজেরাই সেটি ভেঙে ফেলে। ম্যুরালটি শেষ মুহূর্তে কিছু পরিবর্তন আনায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মোট সাড়ে ২৫ কোটি টাকা দাবি করছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিষয়টি নিয়ে বিপাকে বাংলাদেশ বেতার কর্তৃপক্ষ।
তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশ বেতার, শাহবাগ কমপ্লেক্স, আগারগাঁও, ঢাকায় স্থানান্তর, নির্মাণ ও আধুনিকায়ন (১ম পর্যায়) শীর্ষক প্রকল্পটি তৃতীয়বার সংশোধনের আওতায় ম্যুরাল অন্তর্ভুক্ত করা হয়। মূলত ৭ মার্চের ভাষণ সম্প্রচারে বাংলাদেশ বেতারের ঐতিহাসিক ভূমিকার স্মৃতি রক্ষার্থে এ ম্যুরাল স্থাপন করা হয়।
প্রকল্পের মোট ব্যয় ১১৩ কোটি ১৪ লাখ ৯৫ হাজার টাকা। জুলাই ২০১২ সালে শুরু হওয়া প্রকল্পের মূল কাজ ডিসেম্বর ২০১৮ সালে শেষ হয়েছে। পরে নানান কারণে প্রকল্পের ব্যয় ও মেয়াদ বাড়ে। সবশেষ ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ে শুধু ম্যুরাল নির্মাণের জন্য।
সূত্র জানায়, ম্যুরাল নির্মাণে ঠিকাদারের সঙ্গে ২০২১ সালে ৫ কোটি ৭৮ লাখ ৩৪ হাজার টাকায় চুক্তি হয়। নির্মাণ শেষে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধুর মুখাবয়ব ঠিক নেই। এটা ঠিক করতে ২০২৩ সালের ২৫ মে অতিরিক্ত কাজ যুক্ত করা হয়। অতিরিক্ত কাজের পরিমাণ, মূল্য সমন্বয় এবং নতুন নন-টেন্ডারড আইটেম যোগ করে ২৫ কোটি ৫০ লাখ ৬৪ হাজার ২৪৫ টাকা মূল্যের চূড়ান্ত বিল দাবি করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এ আর লিবার্টি।
সরেজমিনে বাংলাদেশ বেতারে গিয়ে জানা যায়, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পদত্যাগের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশব্যাপী বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য, ম্যুরাল থাকায় বিভিন্ন স্থাপনায় ভাঙচুর চালানো হয়। বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল থাকলে বাংলাদেশ বেতারের অন্য স্থাপনায় হামলা ও অগ্নিসংযোগের ভয়ে বেতারের মহাপরিচালক সভা করে তাৎক্ষণিকভাবে ম্যুরালটি ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত নেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ভাঙতে সময় নেওয়া হয় মাত্র ৫০ মিনিট। ম্যুরাল নির্মাণ বাবদ এখন পর্যন্ত ৬ কোটি ৬৪ লাখ টাকার বিল পরিশোধ করা হয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে। কিন্তু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এখন সাড়ে ২৫ কোটি টাকা দাবি করছে।
ম্যুরাল নির্মাণ শতভাগ শেষ হয়েছিল। আমরা ঠিকাদারকে এটা নির্মাণ বাবদ ছয় কোটি ৬৪ লাখ টাকা পরিশোধ করেছি। এ মাসেই উদ্বোধন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ছাত্র-জনতার হামলার ভয়ে নিজেরাই খুলে ফেলেছে।- বাংলাদেশ বেতারের সিনিয়র প্রকৌশলী (কারিগরি কার্য) ও প্রকল্পের পরিচালক প্রবাল কান্তি দাশ
বাড়তি দাবির টাকা পরিশোধে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশ বেতারের নামে মামলার ভয়ও দেখাচ্ছে। এতে উভয় সংকটে পড়েছে বাংলাদেশ বেতার। একদিকে ম্যুরাল নির্মাণ করে ৬ কোটি ৬৪ লাখ টাকা উদ্বোধনের আগেই গুঁড়িয়ে দেওয়ায় গচ্চা গেলো, অন্যদিকে ঠিকাদারের বাড়তি পাওনা পরিশোধের ঝামেলা।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ বেতারের সিনিয়র প্রকৌশলী (কারিগরি কার্য) ও প্রকল্পের পরিচালক প্রবাল কান্তি দাশ জাগো নিউজকে বলেন, ‘ম্যুরাল নির্মাণ শতভাগ শেষ হয়েছিল। আমরা ঠিকাদারকে এটা নির্মাণ বাবদ ছয় কোটি ৬৪ লাখ টাকা পরিশোধ করেছি। এ মাসেই উদ্বোধন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ছাত্র-জনতার হামলার ভয়ে নিজেরাই খুলে ফেলেছে।’
ম্যুরাল নির্মাণে বিপাকে পড়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমরা ছয় কোটির বেশি টাকা পরিশোধ করেছি। এখন তারা নির্মাণ বাবদ ২৫ কোটি টাকা আবদার করছে। এটা আমরা কীভাবে পরিশোধ করবো। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বলছে নির্মাণসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধি ও নির্মাণে বেশি সময়ক্ষেপণ হওয়ায় নানা পণ্য-সেবার দাম বেড়েছে। এজন্যই বাড়তি টাকা চাচ্ছে।’
জানা যায়, শাহবাগ থেকে আগারগাঁও এলাকায় বেতার ভবন স্থানান্তর প্রকল্পের আওতায় শেষ মুহূর্তে ম্যুরাল নির্মাণের বিষয়টি যুক্ত করা হয়। অথচ প্রকল্পের মূল কাজ ২০১৮ সালে সম্পন্ন হয়েছে। নতুনভাবে ম্যুরাল যুক্ত হওয়ায় বিপাকে পড়েছে সবাই। এখন এই ভাঙা ম্যুরালের দায় নিতে চাচ্ছে না কেউ।
এ বিষয়ে জানতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। মেসেজ দিলেও তাতে সাড়া পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশ বেতার জানায়, ম্যুরাল নির্মাণ ও নির্মাণে অসঙ্গতির কারণেই প্রকল্পের সময় বাড়ানো হয়। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে এখন ম্যুরাল নির্মাণ ও টাকা অপচয়ের বিষয়ে কেউ দায়িত্ব নিচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট দপ্তরের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে এই ম্যুরাল।
প্রকল্পের মূল কাজ :
আধুনিক ও ডিজিটাল ব্রডকাস্টিং যন্ত্রপাতি স্থাপন করে ডিজিটাল ব্রডকাস্টিং শুরু করা। বাংলাদেশ বেতার থেকে স্যাটেলাইট ব্রডকাস্টিং ও আঞ্চলিক কেন্দ্রগুলো থেকে উচ্চ মানসম্পন্ন বাংলাদেশ বেতার, ঢাকা কেন্দ্রের অনুষ্ঠান সম্প্রচারে আঞ্চলিক কেন্দ্রগুলোর সঙ্গে স্যাটেলাইট লিংক স্থাপন। আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ বেতারের ষষ্ঠ তলা ভবনটি নয় তলা পর্যন্ত সম্প্রসারণ করে শাহবাগ বাংলাদেশ বেতারের সব অফিস এই ভবনে স্থানান্তরের প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ, ট্রাফিক কার্যক্রম সম্প্রচার, ই-গর্ভন্যান্সের মাধ্যমে ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা।
শুধু ম্যুরাল নির্মাণেই প্রকল্প সংশোধন :
তৃতীয় সংশোধনীতে নতুনভাবে অন্তর্ভুক্ত কাজগুলোর মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ব্রোঞ্জ ম্যুরাল স্থাপন কাজটির ড্রাফট ডিজাইন, কারিগরি নির্দেশ, শিল্পীর যোগ্যতা ইত্যাদি চূড়ান্ত করতে অনেকটা সময় লাগার কারণে দরপত্র আহ্বান করতে কিছুটা বিলম্ব হয়। ২০১৯ সালের ২৬ ডিসেম্বর তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় এ কাজের ড্রাফট ডিজাইন এবং প্রাক্কলন অনুমোদন করে। এর পরে ২০২০ সালের ১৬ জানুয়ারি এ কাজের দাপ্তরিক বাজারদর যাচাই শেষ হয়। ২০২০ সালের ২৬ জানুয়ারি দরপত্র আহ্বান করে নোটিফিকেশন অব অ্যাওয়ার্ড (এনওএ) দেওয়া হয়। করোনা পরিস্থিতির কারণে মূল্যায়ন কাজ দীর্ঘায়িত হয়।
পরে দরপত্রের শর্তানুযায়ী বিশেষজ্ঞ কমিটির মতামত নিয়ে দরদাতার মাধ্যমে এ কাজের ডিজাইন চূড়ান্ত করা হয়। ১৩ জানুয়ারি, ২০২১ সালে ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তি হয়। এক পর্যায়ে নতুন করে লে-আউট প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।
প্রণীত নতুন লে-আউটটি তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় থেকে পুনরায় অনুমোদন গ্রহণ করা হয় ২০২১ সালের ১২ এপ্রিল। মাঝখানে বিভিন্ন কারণে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ম্যুরাল নির্মাণকাজটি বিলম্বে শুরু করে। নতুন করে আবারও দরপত্র শিডিউলের শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়।
ম্যুরাল নির্মাণে টাকার অংক একেবারে কম নয়। একদল এসে তৈরি করলো আরেক দল এসে ভাঙলো। এভাবে চলতে পারে না। কারণ এসব ম্যুরাল জনগণের টাকায় নির্মিত।- অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন
বাংলাদেশ বেতার থেকে জানা যায়, মূল ম্যুরালের মুখাবয়ব যথাযথ হয়নি। মুখাবয়ব ঠিক করতে হবে বলে সরকার নির্দেশনা দেয়। নানা কারণে প্রকল্পটির মেয়াদ আরও ছয় মাস বাড়িয়ে ডিসেম্বর ২০২৩ পর্যন্ত প্রস্তাব করা হয়। পরে আইএমইডির প্রতিনিধি প্রকল্পটি পরিদর্শন করেন। পরিদর্শন শেষে প্রকল্পটির মেয়াদ জুন ২০২৩ পর্যন্ত অনুমোদনের জন্য সুপারিশ করে আইএমইডি। ছয় বারের মতো মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব একনেক সভায় উপস্থাপন করে অনুমোদনের বাধ্যবাধকতা আছে।
সংশ্লিষ্ট বিভাগ জানায়, ৩১ ডিসেম্বর ২০২৩ এর মধ্যে সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে প্রকল্পটি সমাপ্ত করা সম্ভব হবে না বিধায় সার্বিক বিবেচনায় ব্যয় বৃদ্ধি ব্যতিরেকে প্রকল্পটির মেয়াদ আরও ছয় মাস বাড়িয়ে জুন ২০২৪ পর্যন্ত করা হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র আরও জানায়, ম্যুরাল নির্মাণকাজে ঠিকাদারের সঙ্গে পাঁচ কোটি ৭৮ লাখ ৩৪ হাজার টাকায় চুক্তি করা হলেও ২০২৩ সালের ২৫ মে অতিরিক্ত কাজের পরিমাণ, মূল্য সমন্বয় এবং নতুন নন-টেন্ডারড আইটেম যোগ করা হয়। এতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ২৫ কোটি ৫০ লাখ ৬৪ হাজার ২৪৫ টাকা মূল্যের চূড়ান্ত বিল দাবি করে বসে।
অতিরিক্ত কাজের বিষয়ে বিশেষজ্ঞ কমিটির মতামত বিবেচনায় নিয়ে পিআইসি কমিটির পরামর্শে মহাপরিচালক মহোদয়ের মাধ্যমে গঠিত পরিমাপ কমিটি কাজটি সমাপ্ত হলে চুক্তি মূল্যের চেয়ে ১৪ দশমিক ৯৭ শতাংশ অতিরিক্ত কাজ সম্পন্ন হবে বলে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে এবং সে মোতাবেক প্রকল্প পরিচালকের দপ্তর থেকে ভ্যারিয়েশন অনুমোদন করা হয়েছে। কাজটির বিল পরিশোধের বিষয়টি এখনো নিষ্পত্তি করা সম্ভব হয়নি।
বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘ম্যুরাল নির্মাণে টাকার অংক একেবারে কম নয়। একদল এসে তৈরি করলো আরেক দল এসে ভাঙলো। এভাবে চলতে পারে না। কারণ এসব ম্যুরাল জনগণের টাকায় নির্মিত। এসব নির্মাণ করে অর্থের অপচয় করা উচিত নয়। এটা নির্মাণে অর্থনৈতিক যৌক্তিতা নেই। ম্যুরাল বানিয়ে লাভ নেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘যেগুলো বিতর্কের ঊর্ধ্বে তাদের স্মৃতি ধরে রাখা যায় বিভিন্ন ভাবে। বইপত্র লিখেও তাদের ইতিহাস ধরে রাখা যায়। মূলত কিছু অধিদপ্তর ও বিভাগ বেশি হাইলাইট হতেই এসব ম্যুরাল নির্মাণ করে টাকা অপচয় করে। এটা নিয়ে একটা নীতিমালা করা দরকার। যারা তৈরি করলো তারাই উদ্বোধনের আগে ভেঙে ফেললো, তাহলে এত কোটি টাকা গচ্চা গেলো এ দায়ভার কার?’
এ বিষয়ে এই বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ বেতারের মহাপরিচালক রবীন্দ্রশ্রী বড়ুয়া বলেন, ‘আপনি এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক, ঢাকা কেন্দ্রের প্রধান ও প্রধান প্রকৌশলীর সঙ্গে কথা বলেন। ওনারা যা বলবে সেটাই সঠিক তথ্য।’
আপনি মিটিং করে সংক্ষিপ্ত সময়ে ম্যুরাল ভেঙেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে- এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আপনি কি কোনো লিখিত ডকুমেন্ট পেয়েছেন।’ বলে ফোন রেখে দিন তিনি।
সূত্র : জাগোনিউজ